প্রকাশিত: ২৪/১১/২০২০ ৭:১৬ পিএম

ছৈয়দ আলম, কক্সবাজার :
পর্যটন জেলা কক্সবাজারের অন্যতম আকর্ষণ মেরিন ড্রাইভ সড়ক। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজার-টেকনাফ সীমান্তের সাথে সড়কটি শহরের সাথে সৌন্দর্যবর্ধণের মাধ্যমে সহজে যানজটমুক্ত যোগাযোগ সৃষ্টি করেছে। আরামদায়ক যাতায়াতের জন্য যে কেউ এই সড়কটি ব্যবহার করে থাকেন। গত ৩১ জুলাই সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো: রাশেদ খুন হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে আরো আলোচিত হয়ে উঠে এই সড়কটি। এতদিকে যেমন আলোচিত অপরদিকে অভিশপ্ত সড়ক বলেও অনেকেই মতামত ব্যক্ত করেন। এই সড়ক পর্যটকদের জন্য প্রথম পছন্দের তালিকায় রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি টেকনাফ-কক্সবাজারের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট অবৈধ গাড়ি এনে প্রভাব বিস্তার করে মৃত্যুযাত্রী নিয়ে চলাচল করছে। এখন এই মসৃণ আরামদায়ক সড়কটি তাদের দখলে চলে গেছে। বেড়েছে যানবাহন, যাতায়াত এবং শতাধিক গাড়ির রহস্যজনক বিচরণ। এর কারনে বেড়েছে দুর্ঘটনাও। গতকাল টেকনাফ শামলাপুর এলাকায় দোয়েল কার দুর্ঘটনায় শিশুসহ এক মহিলা গুরুতর আহত হয়েছে। এর আগে কারের বেপরোয়া ধাক্কায় দুটি গরু আহত হয়। কয়েকদিন ধরে ইয়াবা পাচারের অভিযোগে আটক হয়েছে অনেকেই। সেই কারনে এখন চেকপোস্টে বাড়তি সতর্কতায় রয়েছে প্রশাসন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে-কমপক্ষে ১৫২টি কার এবং নোহা গাড়ি এই সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি হিসেবে দেখিয়ে অবাধে বিচরণ করছে। এই গাড়িগুলোর প্রত্যেকটিই বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। শুধু যাত্রী পরিবহণই নয় অভিযোগ উঠেছে ইয়াবা পাচারেরও। আর এই কাজ ঘটছে একটি রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের অধীনে। কক্সবাজার শহরের কলাতলী এবং টেকনাফ স্টেশনে বাসস্ট্যান্ড সৃষ্টি, কথিত লাইন তৈরি, সিন্ডিকেট কর্তৃক প্রতিটি গাড়ি থেকে নেতা ও পুলিশের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদা আদায়, দায়হীন গাড়ি চালাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা এবং কৌশলে ইয়াবা পাচারের চিত্র অনুসন্ধানে গভীরভাবে উঠে এসেছে।
জানা গেছে, গাড়ি প্রতি ৪শ’ টাকা করে চাঁদা আদায় করে থাকে গুপ্ত ওই সিন্ডিকেট। যার মধ্যে ২শ’ টাকা নেওয়া হয় কক্সবাজার ছেড়ে যাওয়া প্রাক্কালে এবং বাকী ২শ’ টাকা নেওয়া হয় টেকনাফ ছেড়ে আসার প্রাক্কালে। চাঁদা আদায়ের এই দৃশ্য কলাতলী মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কার ও নোহাগুলোর দিকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেই যে কেউ দেখতে পাবেন। এটা অনেকটাই প্রকাশ্যে। একটি শ্রমিক সংগঠনের নাম ভাঙ্গিয়ে এই চাঁদা উত্তোলন করা হলেও আদায়কৃত টাকার বিপরীতে দেওয়া হয়না কোনো রশিদ কিংবা অর্থ লেনদেনের কোনো কাগুজে প্রমাণ। প্রতিবেদককে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের কার-নোহা যাতায়াতের লাইন সৃষ্টিকারী অঘোষিত মালিক বাহার এবং লাইন পরিচালক বেলাল। এক্ষেত্রে বাহার এর দাবী-তিনি লাইনের মালিক নন। তবে ‘দুই রাজনৈতিক ভাই’ মিলে এসব লাইন চলছে। গত কয়েকমাস আগে থেকে দোয়েল কার এর লাইনে দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এখন দুটি লাইন চলছে। দুটিতে কক্সবাজার ও টেকনাফের ক্ষমতাসীনদলের নেতাকর্মিরা জড়িত রয়েছে। তাদের ইশারায় মূলত এই লাইন পরিচালিত হচ্ছে। তবে কয়েকজন গাড়ির মালিক ও চালক জানিয়েছেন, সম্প্রতি ইয়াবা সিন্ডিকেট এর গাড়ি বেড়ে যাওয়ায় ভাড়া কমে গেছে। আগে দিনে লাইনে ৫/৬ বার আসা-যাওয়া করা যেত। আর এখন গাড়ি বেশির কারনে ২ বার যাওয়া যায়।
এই সড়কে গাড়ি চালায় এমন একাধিক চালক জানিয়েছেন-গাড়ি চালাতে গিয়ে কেন তাদের এই অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয় তারা কেউ জানেন না। গোপনে পুলিশ ও নেতা ভাইদের টাকা দিয়ে এই লাইন চালু রাখতে হয়েছে এমন দাবী করেই নাকি তাদের কাছ থেকে এই টাকা নেওয়া হয়ে থাকে। তারা আরও জানিয়েছে-সীমাবদ্ধ যাত্রী, সময়, তেল-গ্যাস খরচ এবং বাড়তি খরচের বোঝা মাথায় চেপে কোনোভাবেই এসব গাড়ির মালিক তাদের বিনিয়োগকৃত টাকা তুলে আনতে পারার কথা নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়-প্রতিটি গাড়িতে অনধিক ৪ জন যাত্রী বহন করা যায়। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে প্রতিজন যাত্রীর নিকট হতে ভাড়া হিসেবে নেওয়া হয়-৩০০ টাকা। এভাবে প্রতি যাত্রায় ১২শ’ টাকা তাদের আয় হয়। দুরত্ব হিসেবে গাড়িগুলো দৈনিক ৪ বারের বেশি যাতায়াত করা সম্ভবও নয়। অন্যদিকে খরচ দেখা যাচ্ছে- লাইন ভাড়া ৪০০ টাকা। তার সাথে ড্রাইভারের বেতন-৭০০ টাকা। আবার প্রতি ট্রিপে জ্বালানি খরচ হয় কমপক্ষে ৪শ’টাকা। এভাবে সব মিলিয়ে খরচ দাঁড়ায় ১৮শ’ টাকা। গাড়িগুলোর মাসিক কিস্তি পরিশোধ করতে হয় ২৫ হাজার টাকা করে। তাহলে বাকী আরও ৭ হাজার টাকা কীভাবে পরিশোধ করেন তারা-এমন প্রশ্ন এখন সচেতন মহলে। এই বাড়তি টাকার আয়ের উৎস কি? তাদের নির্ধারিত সময় ১ ঘন্টা ১০ মিনিটে দ্রুত গতিতে চলে যায়। এতে অনেক দুর্ঘটনার জন্ম দিয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে-গাড়িগুলো তাদের খরচ তুলে আনতে ৩য় ট্রিপে রাতের বেলা টেকনাফের বিভিন্ন ইয়াবা অধ্যুষিত গ্রামে অবস্থান করে। সেখানে রাত কাটিয়ে সকালে নতুন ট্রিপ নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নতুন বিন্যাসের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে দুস্কৃতিকারীরা বেপরোয়াভাবে পাচার করে যাচ্ছে মাদক তথা ইয়াবা। আর সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বেছে নিয়েছে মেরিনড্রাইভ সড়ক।
টেকনাফ বাহারছড়ার এনজিও কর্মকর্তা ও সমাজসেবক শহিদ উল্লাহ জানান, কোন অদৃশ্য শক্তির আড়ালে নাম্বার-লাইসেন্সবিহীন এই গাড়ি গুলো চলাচল করছে। বেপরোয়া চলাচলে প্রতিনিয়ত ঘটছে দূর্ঘটনা। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।
দীর্ঘতম এই মেরিনড্রাইভ সড়কে তাদের অবৈধ এই পরিবহণ সুষ্ঠু পরিচালনা ও লাইসেন্সসহ চলাচল করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন সচেতন মহল।

পাঠকের মতামত