প্রকাশিত: ০৫/০২/২০১৮ ৭:৫০ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৭:০৪ এএম

নিউজ ডেস্ক::
কথায় বলে ‘ভুল করলে তার মাশুল দিতে হয়। আর পাপ নাকি বাপকেও ছাড়ে না’- দু’টিই জীবন ঘনিষ্ঠ প্রবচন। যার অস্তিত্ব শুধু বইয়ের পাতা আর মানুষের মুখে নয়, বাস্তবেও আছে। সত্যিই আছে? কেমন আছে?

তা নিশ্চয়ই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। এখন তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করছেন, ‘মুমিনুলকে বাদ দিয়ে ভুল করেছিলাম। তার ক্যারিয়ার বিনষ্টের নীল নক্সা করতে গিয়ে যে পাপ করেছিলাম, তারও চড়া মাশুল গুনতে হলো। আমার সময় বাদ পড়া মুুিমনুল তার এবং বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে প্রথম এক টেস্টের উভয় ইনিংসে শতরান করে আমার বর্তমান দল শ্রীলঙ্কার মুখের গ্রাস কেড়ে নিল।’

অথচ তিনজাতি ক্রিকেটের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে টাইগারদের হারের পর বাংলাদেশ ভক্ত ও সমর্থকদের একাংশ হঠাৎ হাথুরু বন্দনায় মেতে উঠলেন। ভাবটা এমন, লঙ্কানদের ওই জয় আসলে হাথুরুর। তিনি মাঠের বাইরে থেকে এমন ছক, কৌশল এঁটেছেন, আর ড্রেসিংরুম ও ডাগআউটে বসে এমন কামান দাগিয়েছেন, যার ফুৎকারে মাশরাফির দল ভুপাতিত।

হাথুরু বাংলাদেশের কোচ ছিলেন। প্রায় চার বছর তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের সাথে ছিলেন। তাদের নিয়ে কাজ করেছেন। প্রত্যেকের হাড়, অস্থি-মজ্জার খবর তার নখোদর্পনে।

কে কোথায় দূর্বল, কার প্লাস পয়েন্ট কী, কোন ক্রিকেটারের মানসিকতা কেমন- এসব তার খুব ভাল জানা। তিনি সব বিচার-বিশ্লেষণ করে সে আলোকেই কৌশল এঁটেছেন। লঙ্কানরা মাঠে তার স্বার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে জয় তুলে নিয়েছে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো ওই হাথুরুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ অংশটি মাথায়ই আনেননি, আসল কাজটি করেছেন লঙ্কান ক্রিকেটাররা। স্লো ও খানিক প্রতিকুল উইকেটে অযথা হাত খুলে খেলে লাভ হবে না। সে সত্য মর্মে মর্মে অনুভব করে উপুল থারাঙ্গা একদিন আগলে রেখে ৫৯ রানের দায়িত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেছেন। কুশল মেন্ডিস, অধিনায়ক দিনেশ চান্দিমাল আর উইকেটরক্ষক ডিকভেলা ব্যাটে অবদান রেখেছেন। এরপর বোলিংয়ে লাকমাল ও অভিষেক হওয়া মধুশঙ্কা বোলিং কার্যকরিতায় শেষ হাসি লঙ্কানদের।

কিন্তু খেলা শেষে কেউ কেউ ধন্য ধন্য হাথুরু বলে চেঁচালেন। খুব জানতে ইচ্ছে করছে, এখন তারা কি বলবেন? বাংলাদেশ তো বুক চিতিয়ে লড়েই লঙ্কানদের জয়ের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। মুমিনুল আর লিটন দাস মিলে এক জুটিতেই প্রায় হারা ম্যাচ ড্র করে দিলেন।

এখন হাথুরুর জারি-জুরি কাজ দিল না? তিনি তো মুমিনুল আর লিটন দাসেরও কোচ ছিলেন। মুমিনুল অফ স্পিনে দূর্বল, অফ স্ট্যাম্পের বাইরের ডেলিভারি আলগা হাতে খেলতে গিয়ে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন। খাট লেন্থের শরীর সোজা ডেলিভারিও ঠিক মত খেলতে পারেন না ঠিকমত। এটা তো বাংলাদেশের কোচ থাকাকালীন হাথুরুই উদ্ভট যুক্তি আবিষ্কার করেছিলেন।

তাহলে কেন মুমিনুলকে অল্প সময় সংগ্রহে ফেরানো গেল না? লিটন দাসও তো প্রচুর শটস খেলেন, কিছুক্ষণ পরপর উচ্চাভিলাসি স্ট্রোক খেলার রোগ মাথাচাড়া দেয়, কই তাকেও তো শটস খেলায় প্রলুদ্ধ করে চট জলদি সাজঘরে ফেরত পাঠাতে পারেনি লঙ্কানরা। কোথায় গেল হাথুরু ম্যাজিক?

আসলে ম্যাজিক-ট্যাজিক কিছু নয়। তাহলে শুনুন, এ মুৃমিনুল হককে বাদ দিয়েছিলেন হাথুরু। যার প্রথম ১২ টেস্টে চার সেঞ্চুরি, গড় বাংলাদেশের যে কোন ব্যাটসম্যানের চেয়ে অনেক বেশি। এক সময় যিনি টানা ১১ টেস্টে পঞ্চাশ বা তার বেশি রান করে ইতিহাস ¯্রষ্টা, সেই ব্যাটসম্যানকে মিথ্যে অজুহাত দিয়ে টেস্ট দলের বাইরে ঠেলে দিয়েছিলেন তখনকার বাংলাদেশের এবং আজকের লঙ্কান কোচ হাথুরু। সৃষ্টিকর্তার কী বিচার! সেই মুমিনুলেই পিষ্ট হলেন হাথুরু।

হাথুরু যে তাকে পছন্দ করতেন না। বাদ দিয়েছেন, কখনো মুখ ফুটে না বললেও নিশ্চয়ই মনের ভিতরে তা পুষে রেখেছিলেন মুমিনুল। আর হাথুরু শ্রীলঙ্কার কোচ হবার পর যেন কঠিন পণ করে ফেলেছিলেন, যে করেই হোক আমাকে ভাল খেলতে হবে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমার জীবনের সেরাটা খেলতে হবে।

মুখে সৌজন্যতাবশতঃ হয়ত কিছুই বলেননি; কিন্তু ভিতরে ছিল ভাল করার অদম্য স্পৃহা। কঠিন ও দৃঢ় সংকল্প। তারই বহিঃপ্রকাশ মাঠে। প্রথম বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান হিসেেেব একই টেস্টের উভয় ইনিংসে সেঞ্চুরি। প্রথম ইনিংসে ১৭৬ আর দ্বিতীয়বার ১০৫ রান।

তার বিগ হান্ড্রেডের ওপর ভর করে প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের স্কোর গিয়ে ঠেকে ৫১৩ রানে। আর এবার দ্বিতীয় ইনিংসে তিন সিনিয়র ও ফ্রন্টলাইনার তামিম, ইমরুল ও মুশফিক আউট হবার পর ঘাবড়ে না গিয়ে অসীম সাহস, অবিচল আস্থা ও নিজের সামর্থ্যরে ওপর বিশ্বাস রেখে খেললেন।

কোন তাড়াহুড়ো ছিল না। বলের মেধা ও গুণ বিচার করে শুধু আলগা ডেলিভারির অপেক্ষায় থাকা। হাফ ভলি, ওভার পিচ পেলেই মাথা নিচু করে ডান পা সামনে এনে ব্যাকরণসম্মত শটে অফ ও অন ড্রাইভে সীমানার ওপারেন পাঠানো। আর খাট লেন্থের বলগুলোকে স্কোয়ার কাট ও পুল করে শাস্তি দিতেও ছিল না কার্পণ্য।

অন্যদিন যেমন মনে হয়, আজও তাই। দেখে মনে হলো যেন এই মাত্র ঘুম থেকে জেগে ব্যাট হাতে মাঠে নেমেছেন মুমিনুল। কোনরকম তাড়াহুড়ো নেই। উইকেটে গিয়ে সমসাময়িকদের মত অযথা ছটফট করা আর চটকদার শটস খেলার প্রবণতা নেই। ইনজামাম-উল হকের মত স্বচ্ছন্দে অবলীলায় খেলে যান।

আর তাতেই সাফল্যের নতুন ইতিহাস গড়া। আগেও বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম তার সাফল্যের পয়মন্তো ভেন্যু। প্রথম ইনিংসে তিন অংকে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সাগরিকায় তার চার নম্বর সেঞ্চুরিও হয়ে যায়।

আজকেরটা নিয়ে এ মাঠেই তার শতরান হলো পাঁচটি। ২০১৩ সালের ২১ অক্টোবর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরিটিই (১২৬) শুধু ঢাকার শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে। এছাড়া মুমিনুলের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে (২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর এই মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৮১ রানের, ৩৭৭ মিনিট ২৭৪ বল ২৭ বাউন্ডারিতে সাজানো)।

এ ছাড়া অন্য দুটির একটি ছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি (১০০) ও আরেকটি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে (২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর ১৩১)। কক্সবাজারের ছেলে মুমিনুল সাগিরকায় ব্যাট হাতে নামলেই হয়ে ওঠেন দূরন্ত-দূর্বার।

তাই তো এ মাঠে তার পাঁচ সেঞ্চুরি পাশে ১৩ ইনিংসে মোট রান (১৮১ ও ২২*; ১৩, ১০০*; ৪৮, ১৩১*; ৬; ০; ২৭; ৩১, ২৯; ১৭৬ ও ১০৫) = ৮৮৩। ভাবা যায়!

একেই বলে নিয়তির খেলা। প্রগতিশীলরা বলবেন প্রকৃতির বিচার। আসলে অন্যের অনিষ্ট চিন্তা কখনই নিজের মঙ্গল ডেকে আনে না। সাময়িকভাবে সুখ অনুভব হলেও সৃষ্টিকর্তা ঠিক বুঝিয়ে দেন, পাপ করলে তার নিস্তার নেই। মুমিনুলকে অন্যায়ভাবে ফন্দি এঁটে বাদ দিয়ে হাথুরুসিংহেও শাস্তি পেয়ে গেলেন। মুমিনুলের ব্যাটিংয়েই যে তার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো!

পাঠকের মতামত