প্রকাশিত: ২৩/০৭/২০২১ ৯:২৬ এএম

মিয়ানমারে মারাত্মক কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঢেউয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যেই চিকিৎসক ধরপাকড়ের অভিযোগ উঠেছে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে।

সেনাবাহিনী স্বাধীনভাবে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা করা কয়েকজন চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করেছে। জান্তা-বিরোধী বিক্ষোভে চিকিৎসকদের সমর্থনের জেরেই তাদের এভাবে ধরপাকড় করা হচ্ছে- বলছে এইসব চিকিৎসকদের সহকর্মীরাসহ গণমাধ্যমও।

গত ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই বিক্ষোভ, অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে মিয়ানমার। দেশজুড়ে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে সাধারণ মানুষ। বিক্ষোভ দমনে নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালিয়েছে। দমনপীড়নে ৯০০’র বেশি মানুষ মারা গেছে। আটক হয়েছে কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী। এসেছে নির্যাতনের খবরও।

জান্তা-বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদেরও অনেকেই। তাদের মধ্যে বহু চিকিৎসক গ্রেপ্তার হয়েছেন। আবার ধরপাকড়, নির্যাতনের ভয়ে অনেক স্বাস্থ্যকর্মীই অন্তরালে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে হাসপাতালগুলোতে সংকট দেখা দিয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ এর সবচেয়ে মারাত্মক সংক্রমণের ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। ঘাটতি রয়েছে অক্সিজেনেরও। স্বাস্থ্যকর্মীর সংকট থাকায় গুরুতর বহু কোভিড রোগী হাসপাতালে যাচ্ছেন না। এতে অনেকে ঘরেই মারা যাচ্ছেন।

সিএনএন জানায়, মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় নগরী ইয়াঙ্গুনে অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে। কোভিড আক্রান্ত অনেকের পরিবারের সদস্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার ভরে নেওয়ার আশায়। মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় ভিড় বাড়ছে সমাধিক্ষেত্রে। সেখানে শোকার্ত মানুষেরা ভিড় করছে, বাড়ছে কফিন। ফলে শেষকৃত্য কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের টানা কাজ করতে হচ্ছে।

বুধবার জান্তা সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন কোভিড শনাক্ত হয়েছে ৬,০৯৩ জন। এ নিয়ে দেশে সংক্রমণ ২৪৬,৬৬৩ ছাড়িয়েছে। আর গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন মারা যাওয়ার সংখ্যা ২৪৭। সরকারি হিসাবে, মিয়ানমারে এ পর্যন্ত কোভিডে মৃতের সংখ্যা বলা হচ্ছে ৫,৮১৪ জন। কিন্তু এর সঙ্গে একমত নন চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবীরা। তারা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা সরকার প্রকাশ করছে না।

সিএনএন এর সঙ্গে কথা বলা কয়েকজন চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবী বলেছেন, জান্তা কোভিডকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা জানান, অক্সিজেন বিক্রি ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে জান্তা সরকার। তাছাড়া, সামরিক বাহিনী পরিচালিত হাসপাতালগুলোতে সাধারণ রোগী ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে কারাগারগুলোতেও।

জান্তার ভয়ে অনেকে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার যারা হাসপাতালে যাচ্ছেন, তাদের অনেকে চিকিৎসা পাচ্ছেন না। কারণ, সেখানে পর্যাপ্ত অক্সিজেন নেই, শয্যা নেই, সেবা দেওয়ার মতো যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর্মী নেই। এ পরিস্থিতিতে জান্তা-বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া কয়েকজন চিকিৎসক অনেকসময় টেলিফোনে কিংবা রোগীর বাড়িতে গিয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা করার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু অন্যান্য আরও চিকিৎসকের বক্তব্য এবং গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, গত কয়েক সপ্তাহে মিয়ানমারের দুই বৃহত্তম নগরী ইয়াঙ্গন এবং মান্দালয়ে সেনাবাহিনী কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া ৯ জন স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসককে আটক করেছে।

সেনাবাহিনী পরিচালিত রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাউন্সিল এক বিবৃতিতে ইয়াঙ্গনে ৫ চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করার খবর অস্বীকার করেছে। কিন্তু মান্দালয়ে চিকিৎসক গ্রেপ্তারের খবরের ব্যাপারে তারা কিছু উল্লেখ করেনি। এ ব্যাপারে জান্তা সরকারের মুখপাত্রের সঙ্গে রয়টার্স যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনও সাড়া মেলেনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, ‘মান্দালয় গ্রুপ- মেডিক্যাল ফ্যামিলি’ থেকে তার চার সহকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। অন্যদিকে, ইয়াঙ্গনে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া একটি চিকিৎসক দলের তিন চিকিৎককে সেনারা কৌশলে গ্রেপ্তার করেছে। এছাড়া, ইয়াঙ্গনের নর্থ ডাগন জেলায় কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করার খবর জানিয়েছে মিয়ানমারের আরেকটি নিউজ পোর্টাল। গণমাধ্যমের এই দুই খবরই জান্তা সরকার অস্বীকার করেছে।

ওদিকে, দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় উঠে আসছে দুর্দশার চিত্র। পর্যাপ্ত কোভিড পরীক্ষা হচ্ছে না। জনসাধারণ জান্তা সরকারকে বিশ্বাস না করায় সংকটের প্রকৃত পরিস্থিতি উঠে আসছে না পরিসংখ্যানে। এছাড়া, কোভিড ঠেকাতে টিকাদানের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সে ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। মিয়ানমারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় চিকিৎসক বলেছেন, “সরকার নামমাত্র সব তথ্য দিচ্ছে। আমরা প্রতিদিনই দেখছি, অনেক রোগীর অবস্থা গুরুতর হচ্ছে এবং প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে।”

মিয়ানমারের ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ এর প্রধান জয় সিংহাল বলেন, “যেভাবে কোভিড সংক্রমণ বাড়ছে, তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। সম্প্রতি প্রতি তিনজনের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় একজনের ভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা বড় ধরনের চাপে পড়েছে। আমাদের অবিলম্বে কোভিড পরীক্ষার আওতা বাড়াতে হবে, শনাক্ত রোগীর সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন, তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং দেশজুড়ে টিকাদান কার্যক্রম বাড়াতে হবে।”

মুখ থুবড়ে পড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা, সরকারি কোনও কোভিড-১৯ পরিকল্পনা না থাকা এবং সর্বোপরি জান্তা সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের অবিশ্বাস থাকার কারণে অনেক চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবী এখন নিভৃতে থেকেই মানুষকে সেবা দিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ফাঁক পূরণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

পাঠকের মতামত