প্রকাশিত: ১৮/০৫/২০১৮ ৪:০৮ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ২:৫০ এএম
সম্পর্কের পালাবদলের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে মাহাথির মোহাম্মদ (বাঁয়ে) এবং আনোয়ার ইব্রাহিম (ডানে)।
সম্পর্কের পালাবদলের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে মাহাথির মোহাম্মদ (বাঁয়ে) এবং আনোয়ার ইব্রাহিম (ডানে)।

ডেস্ক নিউজ : মালয়েশিয়ায় ৯ই মে’র সাধারণ নির্বাচনে বড় ধরণের বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন মাহাথির মোহাম্মদ। এর পরপরই আনোয়ার ইব্রাহিমের কারামুক্তির ঘটনাকে দেশটির নতুন সূচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

কেননা এই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে আনুগত্যের পরীক্ষার লড়াইটা ছিল স্পষ্ট। কেননা তাদের একজন একসময় আরেকজনকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন।

মালয়েশিয়ার বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন রোমের জন ক্যাবট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ব্রিজেট ওয়েলশ।

সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যে এই সম্পর্কের গল্পটি এতোটাই নাটকীয় যে একে শেক্সপিয়ারের নাটকের সঙ্গে তুলনা করা যায়, যেখানে কাহিনীর মধ্যে আনুগত্য, বেইমানি, ট্রাজেডি এবং বিদ্রূপ একের অপরের সঙ্গে মিশে আছে।

ড. মাহাথিরের বয়স এখন ৯২। ১৯৯৯ সালে দেশটির অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি আনোয়ার ইব্রাহিমকে দুর্নীতি এবং সমকামিতার অভিযোগে জেলে পাঠিয়েছিলেন।

জেলে বসে আনোয়ার শেক্সপিয়ারের প্রতিটি গ্রন্থ পড়ে শেষ করেন। কিন্তু তিনি ভাবতেও পারেননি এই নাটকের আবির্ভাব হবে তার রাজনৈতিক জীবনে।

ড. মাহাথির জয়লাভের পর তিনি আনোয়ারের মুক্তি ও ক্ষমা নিশ্চিত করলে দুইজনের সম্পর্ক একই বৃত্তে আসে। শত্রু হয়ে পড়েন বন্ধু, ঠিক শেক্সপিয়ারের নাটকের মতই যেখানে গল্পের এক পর্যায়ে খলনায়ক, নায়ক হয়ে ওঠেন।

স্রোতে গা ভাসানো:

এই দুইজনের সম্পর্ক উন্নয়নের মূলে রয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং একে অপরের ঢাল হওয়া। ড. মাহাথির ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম মি. আনোয়ারকে তার প্রশাসনে জায়গা দেন।

মি. আনোয়ার একজন দৃঢ়চেতা, উদ্যমী ছাত্র নেতা ছিলেন। যিনি সত্তরের দশকে তৎকালীন প্রভাবশালী দল ইউনাইটেড মালায়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন-ইউএনএমও এর বিরুদ্ধে একটি দল গঠন করতে পেরেছিলেন।

হয়ে উঠেছিলেন দেশটির স্থানীয় প্রবক্তা, যিনি ওই শক্তিশালী দলটির বিরোধিতা করতে পেরেছেন।

রাজনীতিতে ইসলামের ব্যবহারের সময়কালে মি. আনোয়ারও একই স্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে ইরানে বিপ্লবের পর বহু দেশে মুসলিম ক্ষমতায়নের যে জোয়ার উঠেছিলো সে সময় মালয়েশিয়ার ধর্মকেন্দ্রীক রাজনীতির শূন্যস্থান দখল করে নেন মি. আনোয়ার।

মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে যে কয়েকটি পালাবদল হয়েছে তার একটি ছিল মি. আনোয়ারকে ইউএনএমও জোটে অন্তর্ভুক্ত করা। তারপর মি. আনোয়ার খুব দ্রুত উপরে উঠতে থাকেন।

এক সময়কার চরম শত্রু আজ হয়েছে বন্ধু।এক সময়কার চরম শত্রু আজ হয়েছে বন্ধু।

তার ব্যক্তিত্ব ও দক্ষতার কারণে তার সমর্থকরা এমনভাবে কাজ করেছে যেন বিরোধীরা একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে চলে আসে।

আশির দশক এবং নব্বইয়ের শুরুটা ছিল মালয়েশিয়ায় জন্য সুবর্ণ সময়, যখন দেশটিতে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন ঘটে।

বিশ্বে যখন এশিয়ার প্রভাব বাড়ছিলো ঠিক তখনই ড. মাহাথির তার নেতৃত্বে মালয়েশিয়াকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে আসেন।

এদিকে, ১৯৯৩ সালে ইউএনএমও এর অধীনে বড় ধরণের জয়লাভের মধ্যে দিয়ে মি. আনোয়ার, ড. মাহাথিরের বিরুদ্ধে একজন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে আবির্ভূত হন।

সে সময় আনোয়ার “এশিয়ার রেনেসাঁ” শীর্ষক একটি বই লেখেন। এভাবে তিনি মালয়েশিয়ার প্রেরণা ও আকাঙ্ক্ষার ওপর জোর দিয়ে নিজেকে এশিয়ার একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে আলাদা পরিচিতি দেন।

তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে খোলাখুলিভাবে আলোচনা শুরু করেন, দুটি পক্ষের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেন, যেখানে এক পক্ষ শুধুই ক্ষমতা ধরে রাখতে চায় এবং অপরদিকে যারা সংস্কারের মাধ্যমে জয় অর্জন করতে চায়।

ভঙ্গুর সময়:

১৯৯৭ সালে এশিয়ার আর্থিক সংকটের পরে মালয়েশিয়ার পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর পরের বছরই মি.আনোয়ার দলের নিয়ন্ত্রণ নিতে ড. মাহাথিরকে চ্যালেঞ্জ করেন।

ওই চ্যালেঞ্জ জুড়ে রাজনৈতিক বিভেদ বা মতাদর্শের লড়াইয়ের চেয়ে বেশি ছিল ব্যক্তিগত আক্রমণ। তবে ক্ষমতার সিঁড়িতে ড. মাহাথির তার দক্ষতা প্রমাণ করায় জনাব আনোয়ার সেই চ্যালেঞ্জ জয়ে ব্যর্থ হন।

এরপর মি. আনোয়ারকে মারধর করা হয় এবং এমন ঘটনার অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় যা মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নাড়িয়ে দেয়।

যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে বিদ্রোহকে কঠোরভাবে দমন করেন মি. মাহাথির। ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর তিনি রাজনৈতিক সংস্কারের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন।

কারাবন্দী আনোয়ার ইব্রাহিমের মুক্তির দাবিতে তার সমর্থকদের বিক্ষোভ।কারাবন্দী আনোয়ার ইব্রাহিমের মুক্তির দাবিতে তার সমর্থকদের বিক্ষোভ।

১৯৯৮-৯৯ সালে এমন একটি প্যাটার্ন তৈরি করা হয় যা দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলা মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে একটি আকৃতি দেয়।

এরপর আবদুল্লাহ বাদাউই ২০০৪ সালে এবং পরবর্তীতে রাজাক ২০১৩ সালে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন সেগুলো তাদেরকে সংস্কারপন্থী হিসেবেই পরিচিতি দিয়েছে। ২০০৩ সালে ড. মাহাথির পদত্যাগের পর আবদুল্লাহ বাদাউই ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং তিনি আনোয়ারকে মুক্তি দেন।

প্রথম দিকে আবদুল্লাহ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও তিনি তার পার্টির অংশীদার এবং জনসাধারণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হন এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে হেরে যান।

আব্দুল্লাহর পতনকে কাজে লাগিয়ে পুনরায় রাজনৈতিক জীবনে ফিরে এসেছেন ড. মাহাথির। যিনি আনোয়ারকে মুক্তি দিয়েছিলেন পরবর্তীতে তিনিও ড. মাহাথিরের রাজনৈতিক ক্রোধের শিকার হন।

মি.মাহাথিরের আরেকটি সফল পদক্ষেপ ছিল ২০০৯ সালে নাজিবকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা। মি.আনোয়ার তখন বিরোধী দলের নেতা ছিলেন। যিনি সফলভাবে বিভিন্ন দলকে ২০০৮ সালে একই ছাতার নীচে নিয়ে আসেন।

নাজিব রাজাক সে সময় ড. মাহাথিরের ভূমিকার পুনরাবৃত্তি করেন। মি. আনোয়ারের বিরুদ্ধে সমকামিতার অভিযোগ এনে তাকে একটি বিতর্কিত বিচারের মুখোমুখি করেন।

তবে শেষপর্যন্ত মি. নাজিব রাজাক মি. আবদুল্লাহর মতো একই ভুল করেন। ব্যর্থ হন জাতীয় নেতৃত্ব ধরে রাখতে।

পরিবর্তনের দিকগুলো:

২০১৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজির রাজাকের বিরুদ্ধে গৃহায়ন খাতে দুর্নীতির ওয়ান এমডিবি কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে এবং তার এমন কিছু সম্পদের তথ্য পাওয়া যায় যেগুলো দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা হয়েছে বলে মনে করা হতো।

এ অবস্থায় খোলাখুলিভাবে নাজিব রাজাকের নেতৃত্বের কড়া সমালোচনা করেছেন ড. মাহাথির। পরে নাজিব রাজাক ড. মাহাথিরের সঙ্গে ব্যক্তিগত আক্রমণে জড়িয়ে যান। তাকে দল থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি মামলা দায়েরের হুমকি দেন।

নাজিব রাজাক দুর্নীতির সঙ্গে তার কোনরকম সংশ্লিষ্টতা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন।নাজিব রাজাক দুর্নীতির সঙ্গে তার কোনরকম সংশ্লিষ্টতা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন।

মি. আনোয়ারের মতো ড. মাহাথিরকেও একই ফাঁদে ফেলতে চান নাজিব রাজাক।

এ অবস্থায় ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ড. মাহাথির বিরোধী দলের সাথে কাজ করতে শুরু করেন এবং নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

এই সম্পর্কের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ জুড়ে ছিল আনোয়ারকে পুনরায় ক্ষমতায় ফেরানো এবং তার মুক্তি এবং ক্ষমা সুরক্ষিত করা।

নাজিবের পতন, আইনের শাসন পুনর্বহাল এবং রাজনৈতিক সংস্কারের ডাক দেয়ার মাধ্যমে চলতি মাসে ৯২ বছর বয়সী মাহাথির বিরোধীদের জয় ছিনিয়ে নেন।

১৯৯০ সালে মি. আনোয়ারের যে এজেন্ডাগুলো এক সময় সমালোচনার শিকার হয়েছিলো সেগুলোই এখন গ্রহণ করা হচ্ছে সেই ব্যক্তির দ্বারা যিনি একসময় তাকে প্রত্যাখ্যান ও শাস্তি দিয়েছিলেন।

এবার মি. আনোয়ারের মুক্তির মাধ্যমে দুইজন পুনরায় জোট বেধেছেন এবং তারা একইসঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন রাজনৈতিক সংস্কারের।

পাকাতান হারাপানের সদস্যদের সঙ্গে মাহাথির মোহাম্মদপাকাতান হারাপানের সদস্যদের সঙ্গে মাহাথির মোহাম্মদ

অবশ্য পুরনো ক্ষত এখনো রয়ে গেছে তবে সেটি একই লক্ষ্য অর্জনের পথে কিভাবে দূর হবে তা পরিষ্কার নয়। ক্ষমতার পালাবদল এবং রাজনৈতিক সংস্কারের কথা উঠলেও দুজনের মধ্যে মত-ভিন্নতাও রয়েছে যথেষ্ট।

তারপরও অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন মালয়েশিয়ানরা আশা করছেন যে এই দুই নেতা ব্যক্তিগত বিষয় ভুলে দেশের উন্নয়নে একত্রে কাজ করবেন।

পাঠকের মতামত

ফেসবুকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানোয় সেনাবাহিনীর হাত ছিল

২০১৭ সালে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার আগে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানোর জন্য যে কয়েক ...

আশ্রয় নেওয়া বিজিপিদের বিনিময়ে বাংলাদেশি বন্দি মুক্তি দেবে মিয়ানমার

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) সদস্যদের ফেরানোর বদলে দেশটির জান্তা সরকারের কারাগারে থাকা ...

মিয়ানমারের পরবর্তী নির্বাচন দেশব্যাপী নাও হতে পারে: জান্তা প্রধান

মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরলে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারের। তবে সে নির্বাচন ...

এমভি আবদুল্লাহতে বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র বসিয়েছে জলদস্যুরা

সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নিজস্ব ...