প্রকাশিত: ২৪/১১/২০২১ ৯:৩৪ এএম

দেশে মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবার মান বিশ্বের তুলনায় অনেক নিচু। পাশের দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কারও ধারেকাছে নেই। ভয়েস কল, মোবাইল ইন্টারনেট উভয় ক্ষেত্রে নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছে না বাংলাদেশের মানুষ। বার বার কল কেটে যাওয়া, ঘন ঘন মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। এর প্রতিফলন ঘটেছে বৈশ্বিক সূচকেও। বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান ওকলার সর্বশেষ প্রতিবেদনে মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে আগের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে।টেলিযোগাযোগ খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, অপারেটরদের পর্যাপ্ত অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ ব্যবহার না করা এবং চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ নেওয়ার কারণেই এমন সমস্যা হচ্ছে। তারা বিষয়টিতে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। ঘাটতি দূর করে সেবার মান বাড়ানোর জন্য তেমন চেষ্টা করছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন সেবা নিয়ে বেসরকারি এনটিটিএন অপারেটর এবং মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে প্রায় এক যুগ ধরে দ্বন্দ্ব চলছে। এ কারণে বাংলাদেশে যথাযথ অবকাঠামো সুবিধা গড়ে ওঠার পরও দেশের শীর্ষ তিনটি মোবাইল অপারেটরের কেউ এক বিটিএস (বেজ ট্রান্সিভার স্টেশন) থেকে আরেক বিটিএসে আদর্শ মানদণ্ড অনুযায়ী ফাইবার অপটিক্যাল সংযোগ নিশ্চিত করেনি। একই সঙ্গে মোবাইল অপারেটররা গ্রাহক অনুপাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বেতার তরঙ্গও বরাদ্দ নেয়নি। ফলে অবধারিতভাবে মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবায় দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো গুণগত মান নিশ্চিত হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা জানান, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবায় অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ অবকাঠামোর প্রায় পুরো সুবিধাই ব্যবহার করা হচ্ছে। এনটিটিএন অপারেটরদের সঙ্গে ইন্টারনেট সেবাদাতাদের (আইএসপি) দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনের অবসান হয়েছে। এ কারণে ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে সেবার মান দিন দিন উন্নত হচ্ছে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সমকালকে বলেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশে ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটকে জনপ্রিয় করাই লক্ষ্য। এ জন্য ব্রডব্যান্ড সেবার উন্নয়নের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আর মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবায় ভয়েস কলের গুণগত মান নিশ্চিত করাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মোবাইল ইন্টারনেট সেবার মানের উন্নতির জন্যও বিটিআরসি পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ করে বিটিএস টু বিটিএস অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ বাড়ানোর বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

অপটিক্যাল ফাইবার ও বেতার তরঙ্গ অপর্যাপ্ত :সম্প্রতি প্রকাশিত বিটিআরসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফোরজি সেবায় বর্তমানে মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে বিটিএস পর্যায়ে গ্রামীণফোনের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশনের ব্যবহার মাত্র ১২ শতাংশ, রবি আজিয়াটা লিমিটেডের ১৮ শতাংশ এবং বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনের ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ গ্রামীণফোনের যত বিটিএস আছে তার মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশের সঙ্গে অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ আছে। ৮৮ শতাংশ চলছে রেডিও মাইক্রোওয়েভ দিয়ে।

বিটিআরসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রামীণফোনে বর্তমানে মাত্র ২ হাজার ১৩৮টি সাইটে অপটিক্যাল ফাইবার কানেকশন আছে। একইভাবে রবির বর্তমানে মোট বিটিএস সংখ্যা ১৩ হাজার ৭৬৬টি। ১৮ শতাংশ হিসেবে রবির মাত্র ২ হাজার ৪৭৮টি সাইটে অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ আছে। বাংলালিংকের বিটিএস সংখ্যা ১০ হাজার ১৪৯টি। ১৩ শতাংশ হিসেবে বাংলালিংকে অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ১ হাজার ৩১৯টিতে। টেলিটকের বিটিএস সংখ্যা ৫ হাজার ৪০০টি। ৬৭ শতাংশ হিসেবে ৩ হাজার ৬১৮টিতে অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন আছে।

আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়নের ঘোষিত নীতি অনুযায়ী, বিশ্বে আদর্শ মোবাইল টেলিযোগাযোগ নীতির মানদণ্ড অর্জন করতে হলে ফোরজি সেবার ক্ষেত্রে বিটিএস পর্যায়ে কমপক্ষে ৮০ শতাংশ অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিবেশী দেশগুলোতেও আন্তর্জাতিক আদর্শ মানদণ্ড অনুসরণ করা হচ্ছে। ভারতে মোবাইল অপারেটররা ৯০ শতাংশের বেশি বিটিএস টু বিটিএস সংযোগ অপটিক্যাল ফাইবার কেবলের আওতায় নিয়ে এসেছে। শ্রীলঙ্কা প্রায় ৭০ শতাংশ বিটিএস টু বিটিএস সংযোগ নিশ্চিত করেছে।

বিটিআরসির প্রতিবেদনে বেতার তরঙ্গ ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, বর্তমানে গ্রামীণফোনের ৮ কোটি ২৩ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ৪৭ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ, রবির ৫ কোটি ১৮ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ৪৪ মেগাহার্টজ, বাংলালিংকের ৩ কোটি ৬৫ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ৪০ মেগাহার্টজ এবং টেলিটকের ৫৯ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে ২৫ দশমিক ২ মেগাহার্টজ বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ রয়েছে। গ্রাহক অনুপাতে বেতার তরঙ্গ বরাদ্দের এই চিত্র এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে সর্বনিম্ন। আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়নের মানদণ্ড অনুযায়ী, আদর্শ সেবার জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ গ্রাহকের জন্য এক মেগাহার্টজ বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ থাকতে হবে।

কেন এই পরিস্থিতি :তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ খাত বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির সমকালকে বলেন, মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবায় উন্নত গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করতে অপারেটরদের জন্য পর্যাপ্ত বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ নিশ্চিত করা যেমন অপারেটরদের ব্যবসায়িক দায়, তেমনি সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থারও বড় দায়িত্ব। সরকারি পর্যায়ে এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে যেন মোবাইল অপারেটররা প্রযুক্তির রূপান্তর এবং বর্ধিত গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ নিতে বিনিয়োগে উৎসাহী হয়। বেতার তরঙ্গের মূল্য অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি হলে পর্যাপ্ত বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ নিতে মোবাইল অপারেটররা ব্যবসায়িক বাস্তবতায় যথেষ্ট আগ্রহী হবে না।

তিনি আরও বলেন, দেশের মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবার মানে ক্রমাগত অবনতির আরও একটি বড় কারণ বিটিএস টু বিটিএস অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ নিশ্চিত না করা। এখন ৮০ ভাগের বিটিএস টু বিটিএস ফাইবার অপটিক্যাল সংযোগ নিশ্চিত করার মতো অবকাঠামো দেশে গড়ে উঠেছে। এরপরও দেশের তিনটি প্রধান অপারেটরের কেউই কেন ২০ শতাংশ ফাইবার অপটিক সংযোগ নিশ্চিত করতে পারছে না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন সেবার জন্য পৃথক এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়ার পর থেকেই মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে বেসরকারি এনটিটিএন অপারেটরদের অঘোষিত দ্বন্দ্ব চলছে। কারণ আগে অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন মোবাইল অপারেটররা নিজেরাই করতে পারত। ২০০৯ সালের পর ট্রান্সমিশন সেবার জন্য এনটিটিএন অপারেটরদের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। একইসঙ্গে মোবাইল অপারেটরদের মোবাইল টেলিকম সেবার পাশাপাশি অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশনের পার্শ্ব ব্যবসার সুযোগও বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে অনেকটা বিদ্রোহী অবস্থান থেকেই তিনটি শীর্ষ বেসরকারি অপারেটর প্রায় পুরোপুরি বিটিএস টু বিটিএস রেডিও মাইক্রোওয়েভ সংযোগের মাধ্যমেই সেবা দিতে থাকে। একেবারে যৎসামান্য অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ সেবা নেয় এনটিটিএন অপারেটরদের কাছ থেকে। ফলে এনটিটিএন অপারেটররা যেমন নিজেদের ব্যবসাও ভালো করতে পারেনি, মোবাইল অপারেটররাও গ্রাহক সেবার কাঙ্ক্ষিত গুণগত মান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

এমটবের বক্তব্য :মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটব মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এস এম ফরহাদ সমকালকে বলেন, গ্রাহক অনুপাতে অপারেটরদের কাছে যে পরিমাণ তরঙ্গ থাকা প্রয়োজন তা বাংলাদেশের অপারেটরদের কাছে নেই। তাছাড়া এদেশে শহর এলাকায় জনঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। ভালো সেবা দেওয়ার জন্য একেকটি অপারেটরের কাছে অন্তত ১০০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ প্রয়োজন। কিন্তু সরকার সে পরিমাণ তরঙ্গ বরাদ্দ দিতে পারেনি।

তিনি আরও বলেন, রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় যেভাবে ভবন নির্মাণ করা হয় তাতে নেটওয়ার্ক ডিজাইন করা অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে। পাশাপাশি ভালো নেটওয়ার্কের জন্য এক টাওয়ারের সঙ্গে আরেক টাওয়ারের মধ্যে অপটিক্যাল ফাইবারের সংযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে টাওয়ারে ফাইবারে সংযোগ আশানুরূপ নয়। এ সমস্ত বিষয় নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে মোবাইল অপারেটররা কাজ করছে। সমকাল

পাঠকের মতামত

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসা দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্যদের ফের ...