প্রকাশিত: ২৩/০৪/২০১৮ ৭:৩৬ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৩:৪৯ এএম

গৌতম লাহিড়ী;;

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রতটের কাছেই বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু শিবির। মাইলের পর মাইলজুড়ে পাহাড় কেটে বালুকাবেলায় বাঁশের বেড়ার পলকা ছাউনিতে দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারে ঘরবাড়ি ছেড়ে ওরা সমুদ্রপথে নৌকা বেয়ে উঠেছে এই পারে। বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকার ব্যতিক্রমী নজির দেখিয়ে ওদের আশ্রয় দিয়েছে। খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা, পড়াশোনা, এমনকি দক্ষতারও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কিন্তু এভাবে কতদিন? নতুন এক বিপদের মুখে এই বিশাল সংখ্যক উদ্বাস্তু। কালবৈশাখীতে এই পলকা বস্তিগুলো খড়কুটোর মতো উড়ে গেলে এক বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে হতভাগ্যরা। সেই সঙ্গে বিপদ বাংলাদেশ সরকারেরও।

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ছেড়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে এমনই একটি শিবির পালংখালীর উখিয়া। তরুণ জেলা শাসক শামিমুল হক পাভেল ঢাকার বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে এখানে পড়ে রয়েছেন গত আট মাস ধরে, যেদিন থেকে রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করেছে। তার দায়িত্বে পাঁচটি শিবির- যুবক-যুবতী, শিশু ও বৃদ্ধ রয়েছে দুই লক্ষাধিক। নিজেই স্বীকার করলেন, ‘রোহিঙ্গারা আসার পর স্থানীয় অর্থনীতি ভেঙে চুরমার। স্থানীয়রা সংখ্যায় ছয় লাখ। কিন্তু উদ্বাস্তুরা দশ লাখেরও বেশি।’ বিপদটা কেবল যে প্রাকৃতিক, তা নয়। এই রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশি-বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। স্থানীয় ভাষা না বোঝার কারণে তারা স্থানীয় যুবকদের নিয়োগ করছে। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে নিয়োগ করায় এদের ব্যক্তিগত পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো ধারণা নেই। ফলে সেই সুযোগে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ঢুকে মানবিক সমস্যাকে হাতিয়ার করে উগ্রবাদী পথে উস্কে দিচ্ছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত রেড ক্রসের এক কর্মীকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগে।

হতাশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের সহজেই বিপথে চালিত করতে অসুবিধা হয় না জঙ্গিদের। তবে জেলা প্রশাসক পাভেল নিশ্চিত করছেন, এখন সেই সমস্যা নেই। কেননা, প্রত্যেক রোহিঙ্গার ব্যক্তিগত পরিচয় লিপিবদ্ধ করে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। সে কারণে কোনো অবাঞ্ছিত ব্যক্তি এলেই তাকে শনাক্ত করতে দেরি হয় না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীও স্বীকার করলেন, ‘এভাবে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতেই হবে। তবে হাসিনা সরকারের সিদ্ধান্ত, যতদিন সমস্যার কোনো রাজনৈতিক সমাধান হচ্ছে না, ততদিন তারা এদের উন্নত জীবন দেওয়ার চেষ্টা করবে সাধ্যমতো।

বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্য অনেক সময় না বুঝে দেওয়ার ফলে তার সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। রোহিঙ্গারা রাখাইনে বাস করত এক অঘোষিত বন্দিশিবিরের মধ্যে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকার অনুমতি দিত মিয়ানমার সেনাশাসকরা। তার পরই ঘরের মধ্যে ঢুকতে হবে। সূর্যাস্তের পরে বাইরে থাকলে নারী-পুরুষের সন্ধান পাওয়া দুরূহ। এভাবে কত মানুষ হারিয়ে গেছে! এখানকার কাহিনী ইহুদিদের ওপর অত্যাচারের কাহিনীকেও হার মানায়। মেয়েদের চোখে এক ভয়ার্ত দৃষ্টি। তাই এখানে ট্রমা সেন্টার খুলে মানসিক চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। এদের মধ্যে শিক্ষার মান একেবারে কম। দক্ষ নয় কোনো কাজেই। আধুনিক জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। পাভেল বলছিলেন, তিনি এক শিবিরে গিয়ে দেখেছেন- এক নারী বিদেশিদের দেওয়া স্যানিটারি ন্যাপকিন সিদ্ধ করছে। সে জানে না এর ব্যবহার। তেমনি কেউ বিদেশি দুধের গুঁড়াকে সাবান ভেবে কাপড় কাচ্ছে। পাভেলের ভয়, যদি ডিটারজেন্টকে দুধ ভেবে খেয়ে বসে, তাহলে কী হবে! তাই ত্রাণসামগ্রী বিলির ওপরেও নজর রাখতে হচ্ছে।

একটা গোটা জাতি নিজের ঘরবাড়ি, চাষের জমি, গরু, টলটলে জলেভরা পুকুর ছেড়ে বাঁশের বেড়ায় তৈরি এক নগরীতে বসতির পত্তন করেছে। প্রথম প্রথম নিজেদের জিনিস দিয়ে পণ্য বদলি করেছে। পরে ধীরে ধীরে টাকার বিনিময়ে ছোট ছোট দোকানহাট তৈরি করেছে। তার মধ্যে পারিবারিক সমস্যা তৈরি করেছে সংকট। কোনো রোহিঙ্গা পুরুষের বিয়ে একাধিক, তেমনি স্ত্রীরও বিয়ে একাধিক। তার সঙ্গে সাত থেকে আটজন সন্তান। ফলে পারিবারিক অসন্তোষ এখানে এক আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক পরিস্থিতি তৈরি করছে।

বঙ্গোপসাগরের ভয়াবহ সাইক্লোন এসব আস্তানা খড়কুটোর মতো উড়িয়ে নেবে। তাই প্রশাসন এখন ব্যস্ত নয়া নিরাপদ আস্তানা তৈরি করতে। কিন্তু সব রোহিঙ্গা সেই নয়া আস্তানায় ফের ঘর বাঁধতে নারাজ। যেমন নারাজ ফের মিয়ানমারের রাখাইনে ফেরত যেতে। ফিরে গেলেই যে নিরাপদ থাকবে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। এখানে বরং বিনামূল্যে খাওয়া-দাওয়া, নিরাপদ জীবন। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান না হলে কেবল বাংলাদেশেই নয়, গোটা উপমহাদেশে বিপদ তৈরি হবে- তাতে সন্দেহ নেই। তাই এখন সবাইকে এই সমস্যা বোঝার সময় এসেছে।

বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ভারতসহ ১২টি দেশের বিদেশি সাংবাদিকদের দলের সফরসঙ্গী হিসেবে কক্সবাজার এসেছি। বিশ্বের কোনো দেশ এভাবে বিদেশি শরণার্থীদের সরকারি কোষাগারের ব্যয়ে আশ্রয় দিয়েছে কিনা সন্দেহ। একমাত্র নজির অতীতে ভারতে- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। উখিয়ার হাকিমপাড়া, জামতলি, বাঘোনা, শামলাপুর, চমমারকুল, নয়াবাজার- এমন সব শিবিরে কোথাও ১০ হাজার, কোথাও ৩০ হাজার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রোহিঙ্গাদের বাস। কেবল আশ্রয় দেওয়াই নয়, অনেক সময় হারিয়ে যাওয়া পরিবারদের মিলিয়ে দেওয়ার কাজও করতে হচ্ছে প্রশাসনকে। সমুদ্রপথে পালিয়ে আসার সময় কেউ হারিয়েছে মা-বাবা আবার স্ত্রী-পুত্র। তারা সবাই জনপথে এসে উঠেছে এই কক্সবাজারে।

নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা থাকলেও প্রশাসনের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। এখানে কোনো কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়নি শিবিরগুলোকে। জেলা শাসকের অভিজ্ঞতা হলো- যারা শিবির ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে, তারা আবার ফিরে এসেছে। কেননা, এত নিরাপদ আশ্রয় আর কেই-বা দেবে? আরাকানি-মগ মিশ্রিত এমন ভাষা বাংলাদেশের অন্যদের পক্ষেও বোঝা সম্ভব নয়। স্থানীয় অনুবাদক সঙ্গে না থাকলে ওদের ভাষাও বোঝা সম্ভব নয়। কেউ কেউ বাংলা বোঝেন। কিন্তু সেই প্রাকৃতিক বাংলা বোঝা দুরূহ। এদেরকে বাংলাদেশি বলে প্রচার করা একেবারেই ঐতিহাসিক তথ্যের বিপরীত বলে বিদেশি সাংবাদিকরা উপলব্ধি করলেন। সম্প্রতি পাঁচ রোহিঙ্গা পরিবারকে রাখাইনে ফেরত নিয়ে মিয়ানমার সরকার গোটা বিশ্বে যে বার্তা দিতে চেয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। এখানে শিবিরগুলোতে কথা বললেই বোঝা যায়, তারা সবাই এখনও আতঙ্কগ্রস্ত। মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনী তাদের ওপর যে অত্যাচার করেছে, তার ভয়াল স্মৃতি এখনও অমলিন। বহু নারী-কিশোরী এখনও মাঝরাতে ভয়ে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। নিদ্রাহীনতায় ভুগছে এক বিশাল জনপদ- এই বুঝি হামলা হলো! কেউই এখনও ফিরে যেতে নারাজ। তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে গ্যারান্টি দেবে কে? মিয়ানমার সরকারের ওপর কোনো আস্থা নেই। অনেকেই আশায় বুক বাঁধছে, যদি আন্তর্জাতিকভাবে অথবা জাতিসংঘ থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়, তাহলেই তারা ফিরতে পারে। রাখাইন অঞ্চলে জাতিসংঘের পুলিশ বাহিনী যদি পাহারা দিতে রাজি হয়, তবেই ফিরতে পারে।

বাস্তব সমস্যা হলো- এক বিশালসংখ্যক মানুষ নাগরিকত্ব পরিচয়হীন হয়ে বেঁচে রয়েছে। তাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার থেকেও জরুরি মানুষ হিসেবে পরিচয় ফিরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ হবে একমাত্র সমাধান। দীর্ঘদিন ছিটমহলবাসী যেভাবে নাগরিকত্বহীন হয়ে বেঁচে ছিল, সেভাবে মিয়ানমারের এক বিশালসংখ্যক সংখ্যালঘু মানুষ মানব-পরিচয়হীন হয়ে বেঁচে রয়েছে। এদের হূত সম্মান ফিরিয়ে না দিতে পারলে এই সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান হবে না।

সমকালের নয়াদিল্লি প্রতিনিধি

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...

একটি ফুল—

একটি ফুল, একটি ফুলের জন্যে কতো নিষ্পাপ গাছ প্রাণ হারালো, এই বর্বর শুকোনের দল বারংবার ...