প্রকাশিত: ১৭/০৯/২০১৮ ৩:১৭ পিএম

ডেস্ক রিপোর্ট – ১৬দিন আগেও কথিত মাদক ‘খাটপাতা’ সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের কোনো ধারনা ছিল না। অন্ধকারে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ঢাকা কাস্টমস হাউস ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এই দুই সপ্তাহে প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের তিন হাজার কেজি ‘খাটপাতা’ নামক জব্দ করা হয়েছে। আসলে এই ‘খাটপাতা’ কী? কীভাবে এলো বাংলাদেশে? এ সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন নিয়ে এবারের আয়োজন- বাংলাদেশে নতুন মাদক ‘খাটপাতা’র অজানা অধ্যায়

‘খাটপাতা’ কী?

আজব নেশাদ্রব্য ‘খাট’ বা ‘মিরা’ নামে এই উদ্ভিদটি নিউ সাইকোট্রফিক সাবস্টেন্সেস (এনপিএস) নামে পরিচিত। অনেকে একে ‘আরবের চা’ বলে থাকেন। ‘ইথিওপিয়ান গাঁজা’ নামেও পরিচিত। যেটি কিনা আন্তর্জাতিকভাবে ‘সি’ ক্যাটাগরির মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

আফ্রিকার দেশ জিবুতি, কেনিয়া, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া ও ইয়েমেনে ওই গাছ পাওয়া যায়। এই নেশাদ্রব্য আফ্রিকার দেশগুলোতে বহু আগে থেকেই প্রচলিত। তবে ইদানীং বিভিন্ন দেশে হেরোইন বা ইয়াবার মতো মাদকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই ভেষজ নেশার পাতা।

টুকরো টুকরো সবুজপাতা। দেখে অনেকেই গ্রিন টি ভেবে গুলিয়ে ফেলতে পারেন। একমাত্র বিশেষজ্ঞের চোখই বলে দিতে পারে, যে এটি কোনো চা বা সাধারণ পাতা নয়। এই হল নতুন ধরনের মাদক ‘খাট’। মাদকসেবীরা এ পাতাটিকে চিবিয়ে বা পানিতে ফুটিয়ে চায়ের মতো খেয়ে থাকে।

‘খাট’ মূলত পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে সোমালিয়া ও ইথিওপিয়াতে উৎপন্ন হয়। সেখান থেকে রফতানি হয় ইউরোপ আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যসহ অস্ট্রেলিয়ায়।

সম্প্রতি ঢাকায় এনপিএসের কয়েকটি চালান বাজেয়াফত করে শুল্ক বিভাগ। তার পরেই শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন এ মাদকের নাম।

শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো এলাকাসহ রাজধানীর কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার কেজি খাট জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদার।

সর্বশেষ চালানটি ইথিওপিয়া থেকে দেশের ২০টি ঠিকানায় ‘গ্রিন টি’ হিসেবে আনা হয়েছিল। যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা। খাটের প্রধান আমদানিকারক পূর্ব আফ্রিকার কয়েকটি দেশ।

‘ইথিওপিয়ান গাঁজা’ খ্যাত খাটপাতা। ছবি: ডয়েচে ভেলে

১১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের ডিআইজি শাহ আলম বলেন, বাংলাদেশকে এ মাদকপাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

তবে দেশের ভেতর এই মাদকের ভোক্তা আছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে বলে জানান নজরুল ইসলাম শিকদার। তবে বাংলাদেশেও যে কোনো ধরনের মাদকের প্রবেশ ঠেকাতে আইনের মাধ্যমে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশে ‘খাটপাতা’ কীভাবে এলো

ইথিওপিয়ান এই গাঁজার ৮৬১ কেজির বড় একটি চালান প্রথম ৩১ আগস্ট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উদ্ধারের কথা জানিয়েছিল মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। চালানটি ইথিওপিয়া থেকে বাংলাদেশে পাঠান জিয়াদ মোহাম্মদ ইউসুফ নামের এক রপ্তানিকারক।

তার ঠিক ১০ দিন পর জিপিও বৈদেশিক পার্সেল শাখা থেকে ৯৬ কার্টনে ভর্তি এক হাজার ৫৮৬ দশমিক ৩৬ কেজি খাট উদ্ধার করে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম টিম। এরপর একই মাদকের ১৬০ কেজি ওজনের আরেকটি চালান জব্দ করে কাস্টমস হাউস ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

ওই চালানও ইথিওপিয়া থেকে জিয়াদ মোহাম্মাদ ইউসুফ ঢাকায় পাঠান। নাওয়াহিন এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ইথিওপিয়া থেকে চালানটি পাঠানো হয়।

এদিকে প্রথমে আসা তিনটি চালান ধরা পড়ার পরও আরও একটি এনপিএসের চালান পাঠানো হয় গত ১০ সেপ্টেম্বর। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চালানটি জব্দ করে ঢাকা কাস্টমস হাউস ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। ২০ লাখ টাকা সমমূল্যের ১৪০ কেজি এনপিএস বা ইথিওপিয়ান গাঁজা পাওয়া যায় এই চালানে। তবে এর সঙ্গে জড়িত কাউকে আটক করা যায়নি।

ঢাকা কাস্টমস হাউসের উপপরিচালক অথেলো চৌধুরী জানান, একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় ভারত থেকে জেট এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে (নং-৯ ডব্লিউ২৭৬) আসা আটটি সন্দেহজনক কার্টন জব্দ করে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। পরে বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার উপস্থিতিতে কার্টনগুলো খুলে ভেতর থেকে গ্রিন টির মতো দেখতে ওই মাদকগুলো জব্দ করা হয়।

বাংলাদেশে ১৬শ কেজি এনপিএস বা ‘খাটপাতা’ আনার সময় চালানের গায়ে লেখা ছিল পণ্যটির নাম—‘গ্রিন টি’। কিন্তু যখন ধরা পড়লো, দেখা গেল পাতাগুলো গাঁজাজাতীয় নেশার দ্রব্য।

আফ্রিকার দেশ ইথিয়পিয়া থেকে দুই কোটি ৩৭ লাখ ৯৫ হাজার ৪০০ টাকা মূল্যের ‘গ্রিন টি’র নামে যে মাদক পাতাগুলো আনা হচ্ছিল, সে বিষয়টি গোপন করা হয়েছিল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে।

গত বেশ কয়েকদিন ধরেই হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ধরা পড়ছে এনপিএস বা ‘খাটপাতা’। ১১ সেপ্টেম্বর সকালে দেড় হাজার কেজি ‘খাটপাতা’ জব্দ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সিরিয়াস ক্রাইম শাখা। চার দিনের মাথায় আজ শনিবার আরও ২০ কেজি খাতপাতা উদ্ধার করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পঞ্চম দফায় জব্দ করা হয় গাঁজার পাতা সদৃশ্য খাটপাতা।

নতুন মাদক ‘খাট’ মানবদেহের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। ছবি: গ্যাটি ইমেজ

মঙ্গলবার পর্যন্ত মোট ৪২ কার্টনে করে পাতাগুলো আনা হয়। এ পর্যন্ত জব্দকৃত পাতা কার্টন সংখ্যা ৯৬টি। বিমানবন্দরের বৈদেশিক পার্সেল শাখা থেকে এসব মাদক জব্দ করা হয়। একটি প্রতিষ্ঠানের নামে বাংলাদেশে এসেছে মাদকের চালানটি।

ডিআইজি শাহ আলম বলেন, ‘এশিয়া এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান মাদকগুলো আমদানি করছিল। কোম্পানিটি এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬০০ কেজি ইথোপিয়ান গাজা বা এনপিএস আমদানি করেছে।

তবে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি এই মাদক দেশে আনার জন্য সহায়তা করেছে কি না বা তার নাম ও ঠিকানা জানতে পারেনি সিআইডি।

ডিআইজি বলেন, ‘নাম না জানা গেলেও কার্টনের গায়ে যে ঠিকানা ব্যবহৃত হয়েছে তা যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। কার্টনের গায়ে যে মোবাইল নম্বরটি রয়েছে তা বন্ধ রয়েছে। এই নেশাদ্রব্য পাতার বহনকারী ও আমদানীকারক প্রতিষ্ঠানকে খোঁজার চেষ্টা চলছে।’

শাহ আলম বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে পেরেছি। তবে তারা আসল প্রতিষ্ঠান কিনা তাও যাচাই করা হচ্ছে। এর সাথে যারাই জড়িত থাকবেন কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। ইতিমধ্যে পল্টন থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। সেই মামলার তদন্তে অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে।’

মাদক ব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন কৌশলে মাদক দেশে আনছে জানিয়ে ডিআইজি শাহ আলম বলেন, ‘তারা বিভিন্ন কৌশলে মাদক দেশে নিয়ে আসছে। তারই অংশ হিসেবে গ্রিন টি নামে একটি চালান আসবে বলে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি। জব্দকৃত এই মাদকের বাজারমূল্য দুই কোটি ৩৭ লাখ ৯৫ হাজার ৪০০ টাকা।’

বাংলাদেশে খাট আমদানির পেছনে যেসব গড ফাদার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি রয়েছে তাদের খুব দ্রুতই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলেও জানান ডিআইজি শাহ আলম।

এসব মাদক উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার রাজীব ফারহান বলেন, ইয়াবার চাইতেও ক্ষতিকারক চা পাতার মতো দেখতে এ মাদকের সঙ্গে ইয়াবার কাঁচামাল মিশিয়ে ট্যাবলেট তৈরি করা যায়।

ঢাকা কাস্টমস হাউসের উপপরিচালক অথেলো চৌধুরী বলেন, ইথিওপিয়ার জিয়াদ মোহাম্মদ ইউসুফ মাদকের কার্টনগুলোর রপ্তানিকারক। এটি আমদানি করেছে তুরাগের বাদলদীর ২ নম্বর রোডের ২৮ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত এশা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক খোরশিদ আলম জানান, এনপিএসের চালানটি কয়েক দিন আগে ইথিওপিয়া থেকে ঢাকায় আনা হয়েছে। এনপিএস অনেকটা চায়ের পাতার মতো দেখতে। পানির সঙ্গে মিশিয়ে তরল করে এটি সেবন করা হয়। সেবনের পর মানবদেহে অনেকটা ইয়াবার মতোই এক ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এক ধরনের গাছ থেকে এনপিএস তৈরি করা হয়।

এদিকে সিআইডির একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০টি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির মধ্যে তুরাগের বাদলদীর এশা এন্টারপ্রাইজের নামে ৪১টি। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা আলমগীরের নামে আটটি, একরামুলের নামে পাঁচটি, সাইফুলের নামে চারটি, উজ্জ্বল ও ওবায়েদের নামে তিনটি করে; মুন্না, বাদল এবং আরিফ ও মুশফিকের নামে দুইটি করে ও আমিন, আতিকুল্লাহ, শাহআলম, জয়, রাশেদ, মিজান ও রুহুল আমিন মোল্লার নামে একটি করে চালান এসেছে।

অপরদিকে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি প্রতিষ্ঠানের নামে একটি চালান এসেছে। ইতিমধ্যে সিআইডি তাদের মধ্যে কয়েকজনকে শনাক্ত করেছে বলে জানা গেছে।

ভারতেও ‘খাটপাতা’

প্রতিবশি দেশ ভারতের কলকাতা বিমানবন্দরে প্রথম খাট ধরা পড়ে ২০১৪ সালের ৩ মার্চ। খিদিরপুরের দুই যুবক আসিফ আলম এবং নিজামুদ্দিন শেখ ৮০ কিলোগ্রাম খাট-পাতা নিয়ে পাড়ি দিচ্ছিলেন চিনের কুনমিং শহরে।

বেশ কিছু দিন ধরেই খাট পাচারের খবর আসছিল শুল্ক বিভাগের অফিসারদের কাছে। ৩ মার্চ রাতে ওই দুই যুবকের গতিবিধি দেখে সন্দেহ হয় তাঁদের। ব্যাগ তল্লাশ করতেই বেরিয়ে পড়ে নটেশাকের (কলকাতার স্থানীয় শাক) মতো দেখতে ওই পাতা।

কলকাতার শুল্ক দফতর জানায়, ঠান্ডা জায়গায় না-রাখলে খাট-পাতার গুণ নষ্ট হয়ে যায়। তাই আসিফ ও নিজামুদ্দিন ব্যাগের গায়ে ফুটো করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ২০০ গ্রামের এক-একটি আঁটি মোড়া ছিল কলাপাতায়।

শুল্ক দফতর জানিয়েছে, জলপথে মুম্বই ও কলকাতা বন্দর দিয়েই খাট ঢুকছে ভারতে। দেখতে শাকের মতো, তাই অন্যান্য শাকসব্জির মধ্যে সহজেই মিশিয়ে ফেলা যাচ্ছে একে। আলাদা করে চিহ্নিত করাই মুশকিল।

দেশে দেশে খাটপাতা নিষিদ্ধ

এ মাদক মানুষের শারীরিক ও মানসিক দুভাবেই ক্ষতি করে থাকে। এ কারণে ২০১৭ সালের মধ্যে ১১০টি দেশ এই খাটকে মাদক হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের দেশে আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ ইউনিটের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে।

একসময় ব্রিটেনের শতাধিক ক্যাফেতে এ খাট অবাধে বিক্রি হতো। যার বেশিরভাগ ক্রেতা ছিল সোমালি, ইয়েমেনি ও ইথিওপিয়ান নাগরিকরা।

খাটপাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন তরুণ। ছবি: ডয়েচে ভেলে

‘খাটের’ ভয়াবহতার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে ২০১৪ সালেই ব্রিটিশ সরকারসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ এর আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

তবে ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার মতো কয়েকটি দেশে এখনও রয়েছে খাটের অবাধ ব্যবহার। এর প্রাকৃতিক স্টিমুলেটিং উপাদান মুহূর্তেই সেবনকারীকে চাঙ্গা করে তোলায় তারা এটিকে চা কফির মতোই মনে করে।

‘খাটপাতা’র ৭টি ভয়ঙ্কর রূপ

ঢাকা কাস্টমস হাউসের উপপরিচালক অথেলো চৌধুরী বলেন, ‘এটি পানির সঙ্গে মিশিয়ে তরল করে সেবন করা হয়। সেবনের পর মানবদেহে এক ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি করে। অনেকটা ইয়াবার মতো প্রতিক্রিয়া হয়। এটি বাংলাদেশে আনা নতুন এক ধরনের মাদক।’

এর প্রতিক্রিয়া অনেকটা ইয়াবার মতো। এক ধরনের গাছ থেকে এই ‘খাট’ বা এনপিএস তৈরি হয়। আফ্রিকার দেশ জিবুতি, কেনিয়া, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া ও ইয়েমেনে ওই গাছ পাওয়া যায়।

এই নেশাদ্রব্য আফ্রিকার দেশগুলোতে বহু আগে থেকেই প্রচলিত। তবে ইদানীং বিভিন্ন দেশে হেরোইন বা ইয়াবার মতো মাদকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই ভেষজ নেশার পাতা।

এই নেশাদ্রব্য যৌন উদ্দীপনা বাড়াতে বা দীর্ঘ সময় জেগে থাকতে সাহায্য করে। তবে এটি সেবনে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

ভেষজ এ উদ্ভিদটি অন্যান্য প্রাণঘাতী মাদকের মতোই ভয়ঙ্কর বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। খাটের ৭টি ভয়াবহ প্রভাব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন-

* খাট সেবনকারী নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। প্রচুর অর্থহীন কথা বলে।

* বিভ্রান্ত ও নির্লিপ্ত হয়ে যায়। নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে।

* ঘুমের সমস্যা হয়।

* তীব্র মানসিক উদ্বেগ ও আগ্রাসনে আক্রান্ত হয়।

* বারবার চাবানোর ফলে দাঁত সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়।

* মুখে ক্যান্সার হওয়ারও আশঙ্কা থাকে।

* যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায়।

‘খাটপাতা’ সম্পর্কে অজানা ৮ তথ্য

সোমালিল্যান্ডের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং জনজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে নেশাদ্রব্য ‘খাট’। ছেলে-বুড়ো, ধনী-গরীব সবাই এখন ‘খাট’-এ আসক্ত। সোমালিয়ার স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল সোমালিল্যান্ডের আজব এক মাদক ‘খাটপাতা’র অজানা অধ্যায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে। সে তথ্যগুলো যুগান্তর পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-

সবারই চাই ‘খাট’

সোমালিল্যান্ডের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ ‘খাট’-এ আসক্ত। এটা না চুষলে তাঁদের যেন জীবন অচল। এ নেশার জন্য বেকারদেরও টাকার অভাব হয়না। বেকার যুবক আব্দিখালিদ ধার করে নেশা করে যাচ্ছেন এবং নিশ্চিন্তেই বলছেন, ‘‘নেশা করার টাকা এখন বন্ধুরা দেয়। আমি কোনো কাজ পেলেই ধারটা শোধ করে দেবো।’’ প্রতিদিন খাট-এর পেছনে ১ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৯ লক্ষ ৩০ হাজার ইউরো খরচ করে সোমালিল্যান্ডের মানুষ।

মদের চেয়ে ভালো? শক্তি জোগায়?

খাট নাকি মদের চেয়ে ভালো, এই নেশা নাকি শক্তি জোগায়। খাট-এ আসক্তদের অনেকে মনেপ্রাণে তা বিশ্বাস করেন। এক সাংবাদিক বললেন, ‘‘এটা নেয়ার পর স্বাভাবিকভাবে কাজ করা যায়।’’

‘খাট মা’

রাস্তার পাশেই অসংখ্য ‘খাট’-এর দোকান। ব্যবসাটা মূলত মহিলারাই চালান। স্থানীয়রা তাঁদের ডাকেন ‘খাট মা’ নামে। জাহরে আইদিদ একসময় ছিলেন কফি বিক্রেতা। অন্য ব্যবসাও করেছেন। কিছুতেই দারিদ্র্য যাচ্ছিল না। অবশেষে এলেন খাট ব্যবসায়। এখন ভালো আছেন। এক দাঁতের ডাক্তারের চেম্বারের পাশেই তাঁর দোকান। শত শত ক্রেতা আসে প্রতিদিন। জনপ্রতি অন্তত ৬ থেকে ১০ ডলার খরচ করেন খাট-এর পেছনে।

গৃহযু্দ্ধের ‘উপহার’!

২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সোমালিল্যান্ড ছিল গৃহযুদ্ধের কবলে। গৃহযুদ্ধ শেষে ভয়াবহ রূপে দেখা দেয় অর্থনৈতিক সংকট। নারীরা উপার্জনের কোনো পথ পাচ্ছিলেন না। খাট ব্যবসা সহজ, বেশি পুঁজিরও প্রয়োজন হয় না বলে অসংখ্য নারী চলে আসেন এই ব্যবসায়। এখন খাট-আসক্ত নারীও বাড়ছে। সোমালিল্যান্ডের ২০ ভাগ নারী এখন খাট-এ আসক্ত। নারীরা অবশ্য নেশা করেন গোপনে।

‘খাট এক্সপ্রেস’

ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলে উৎপাদিত হয় খাট। সেখান থেকে ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয় সোমালিল্যান্ডে। নতুন ঠিকানায় খাট আশ্রয় নেয় বিশেষ নাম্বারে চিহ্নিত কোনো দোকানে। ক্রেতাদের সুবিধার্থে প্রতিটি দোকানের সামনেই লেখা হয় শনাক্তকরণ নম্বর।

রাজস্ব আয়ের উৎস

সোমালিল্যান্ডের অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে খাট। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী গত অর্থবছরে সোমালিল্যান্ডের ১৫২ মিলিয়ন ডলারের বার্ষিক বাজেটের ২০ শতাংশই এসেছিল খাট খাত থেকে। তাতে অবশ্য নেশাদ্রব্য নিয়ে সমালোচনা থামেনি। পরিবার ও সমাজ জীবনে নেশাদ্রব্য এবং নেশাগ্রস্তদের কুপ্রভাব নিয়ে অনেকেই চিন্তিত।

পুরুষ নেশা করছে, খেটে মরছে নারী

খাট-এর কারণে অনেক পরিবারই ভুগছে। নেশাগ্রস্ত পুরুষরা ঘরেই কাটাচ্ছে সময়, অন্যদিকে সংসার চালানোর দায়িত্ব এককভাবে পালন করতে গিয়ে খেটে মরছে মেয়েরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফাতিমা সাঈদ জানালেন, ‘পুরুষরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে বসে (খাট) চুষে। এর আসক্তি খুব ভয়ংকর। খাটের কারণে দৃষ্টিভ্রম, অনিদ্রা, ক্ষুধামন্দাসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।’

নেশাগ্রস্তদের ‘সাফাই’

আসক্তরা খাট-এর পক্ষে সবসময়ই সোচ্চার। তাঁরা মনে করেন, এই নেশার উপকারই বেশি। খাট মানুষকে একতাবদ্ধ করে এবং খাট সেবনের সময় সবার মধ্যে সুখ-দুঃখের কথা হয়। যাঁরা নেশা করছেন তাঁরা তো চাইবেনই না, খাট সেবন বন্ধ হোক। ইথিওপিয়াও তা কখনো চাইবে না। সোমালিল্যান্ডে বছরে ৫২৪ মিলিয়ন ডলারের খাট বিক্রি করে ইথিওপিয়া। খাট বন্ধ হলে আয়টাও যে বন্ধ হবে!

পাঠকের মতামত

পবিত্র ঈদুল ফিতর আজ

‘ঈদ এসেছে দুনিয়াতে শিরনি বেহেশতী/দুষমনে আজ গলায় গলায় পাতালো ভাই দোস্তি’- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ...