প্রকাশিত: ০৭/০৬/২০১৮ ৯:১২ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ২:০৬ এএম

ডেস্ক রিপোর্ট::
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের নিধনযজ্ঞের শুরুতেই টার্গেট বানানো হয় শিক্ষক ও মওলানাদের। সবার আগে তাদেরকেই বেছে বেছে হত্যা করে সে দেশের সেনাবাহিনী। শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতারাই ছিলেন প্রথম দিকের হত্যাযজ্ঞের টার্গেট। কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টকে এসব কথা বলেছেন। বিশ্লেষকরা সেনাবাহিনীর এই অবস্থানের সঙ্গে জার্মান হলোকাস্টের মিল খুঁজে পেয়েছেন। ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তাবাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর সেখানকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার। এ অভিযানে সেনাবাহিনীর সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা রাখাইনে রোহিঙ্গাবিরোধী সেনানিপীড়নের মধ্যে জাতিগত নিধন ও গণহত্যার আলামত পেয়েছে।

ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এর সরেজমিন অনুসন্ধান অনুযায়ী, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতারাই কাঠামোবদ্ধ হত্যাযজ্ঞের প্রথম শিকার। মোহাম্মদ হাসিম নামের এক রোহিঙ্গা জানান, সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় তিনি পাহাড়ে লুকিয়েছিলেন। দেখতে পাচ্ছিলেন তার শিক্ষক ভাইকে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এমন অনেক শিক্ষককেই হত্যা করেছে সেনাবাহিনী। ইন্ডিপেন্ডেন্ট বলছে, সেনারা শিক্ষিতদেরকেই আগে হত্যা করে যেন এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে কেউ আওয়াজ তুলতে না পারে। হত্যাযজ্ঞের গবেষকরা একে ‘অনেক পুরোনা কৌশল’ আখ্যা দিয়েছেন। হাশিম বলেন, ‘আমার ভাই অনেকবার প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছে। তিনি বলেছেন আমি শিক্ষক। আমাকে ছেড়ে দিন। কিন্তু সরকার শিক্ষকদেরই আগে হত্যা করতে চেয়েছে।’

বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গারা জানান, ২৫ আগস্ট হামলার পর সেনারা এসে খুঁজছিল এবং জিজ্ঞাসা করছিল, ‘শিক্ষকরা কোথায়?’ ২৬ বছর বয়সী হাইস্কুল শিক্ষক রহিম নিজেই পড়েছেন এই পরিস্থিতিতে। তিনি সেনাসদস্যদের বাচ্চাদের পড়াতেন। ফলে তাকে ভালোমতোই চিনত সবাই। অভিযানের দিন তিনি দেখতে পান তার দিকে সেনারা এগিয়ে আসছে। তিনিবলেন, ‘আমি জানতাম ধরা পড়লেই আমাকে খুন করা হবে। আমি সবসময়ই সাধারণ মানুষের কথা বলে এসেছি। তারা জানত আমরা না থাকলে বাকি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যা খুশি করতে পারবে তারা।’

গবেষকরা জার্মান হলোকাস্টসহ অন্যান্য হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের মিল পেয়েছেন। ইউএস সিশোয়াহ ফাউন্ডেশনের গবেষণাবিষয়ক পরিচালক ক্যারেন জাংব্লাত মন্তব্য করেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের কথা শুনে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। প্রথমে আপনি রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের হত্যা করবেন। এরপর সাধারণ মানুষদের মারবেন। তারপর ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেবেন।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাখাইনের এক সেনাকর্মকর্তা বলেন, তারা ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি মেনে নিতে পারেননি। ‘কারণ তারা মিয়ানমারের কেউ না। ‘ওই সেনাকর্মকর্তার দাবি, শিক্ষিতদের টার্গেট করেনি তারা।

গত নভেম্বরে ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্খা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের পরিচয় মুছে দিতেই এই অভিযান চালানো হয়েছে। বৌদ্ধ স্কুলগুলোতে রোহিঙ্গা শিশুদের পড়তে দেওয়া হয়নি। সরকারি কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও যেত না।

ইন্ডিপেন্ডেন্টজানায়, ২৫ আগস্টের ঘটনার কয়েক মাস আগে রোহিঙ্গা ভাষা শেখানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। গোপনেও তেমনটা করা সম্ভব হচ্ছিল না। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন গত সেপ্টেম্বরে ৬৫ জন শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন। হাইকমিশনারের দফতর জানিয়েছে, ‘মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনী শিক্ষক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় নেতাদের লক্ষ্য করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল রোহিঙ্গা ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধ্বংস করা।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, তাকে বারবারই এমন কাজ করা থেকে বিরত করা হয়েছে। গোপনেও এমন কার্যক্রম চালাতে পারতেন না তারা। নিরাপত্তাবাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার চার দিন আগেই ৩০০ সেনা তার বাড়ি ঘিরে ফেলে বলেও জানান তিনি। তাকে সন্তানসহ হাতকড়া পরিয়ে স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে তিনি আরও শিক্ষক ও পাঁচ জন মোল্লাকে দেখতে পান। তার ছেলেকে তার সামনেই লাথি মারা হচ্ছিল ও পেটানো হচ্ছিল। নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন ওই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘আমার গ্রামে কয়েকজন শিক্ষিত মানুষ বেঁচে আছেন। কিন্তু তারা কখনও আওয়াজ ‍তুলবেন না। তাদের কথা বলার কেউ নেই। এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’

আগস্টে নিধনযজ্ঞ শুরুর কয়েক মাস আগেই চেনকার নামের এক গ্রামে বৈঠক ডেকেছিল সেনাবাহিনী। সে সময় গ্রামবাসীদের কাছ থেকে নদীর মাছ দাবি করেছিল তারা। কেফয়েত উল্লাহ নামের এক শিক্ষক হাত তুলে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনাদেরকে কেন আমাদের এত টাকা দিতে হবে?’ সাথে সাথে তাকে জরিমানা করা হয়। এরপর থেকে প্রতিদিন সকালে তাকে সামরিক ক্যাম্পে যেতে হতো। বাড়িতে তল্লাসির পাশপাশি কারাদণ্ডের হুমকিও দেওয়া হয় তাকে।

রোহিঙ্গারা প্রায় সবাই বলেছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের মধ্যে থেকে শিক্ষিত লোকদের বেছে বেছে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। তাদের দাবি, শিক্ষক, মোল্লা ও অন্যান্য শিক্ষিত রোহিঙ্গাদের টার্গেট করছিল সেনাবাহিনী। নির্যাতনের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের কণ্ঠরোধ করে দিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই কাজ করেছে। অন্য রোহিঙ্গারা ইন্ডিপেনডেন্টকে জানান, মাওলানা রহমত উল্লাহ নামের একজন বলেন, ‘তারা চায় না আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলি, আমরা বলতেও পারিনি। আমি কথা বলতে চেয়েছি। কিন্তু তারা আমাকে গ্রেফতার করে অত্যাচার করত।’ রহমত উল্লাহ আরও বলেন, ‘আমাদের ইতিহাস শোনানোর জন্য আর বেশি মানুষ বেঁচে নেই। শেষ কয়েকজনের মধ্যে আমি। আমরা সবাই অনেক চাপে ছিলাম।’

পাঠকের মতামত