প্রকাশিত: ২৩/০৬/২০১৬ ৭:৫৪ এএম

IMG_0_011350~1আতিকুর রহমান মানিক।

২৩ জুন। বাঙ্গালী জাতির জন্য চরম বেদনাদায়ক ঐতিহাসিক পলাশী দিবস আজ। দেশীয় কিছু বিশ্বাসঘাতক ও কুলাঙ্গারের কারনে বাঙালির ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় রচিত হয়েছিল আজকের এ দিনে। ক্ষমতালোভী কয়েকজন নরপশুর বিশ্বাসঘাতকতার ফলে প্রায় দুইশ বছরের গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়েছিল প্রিয় মাতৃভূমি। দেশীয় একদল বিশ্বাসঘাতকের পাপের দায়শোধে ১৯০ বছরের পরাধীনতা ও হাজারো প্রানের মাশুল দিয়েছে এ জাতি।  বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উ-দ্দৌলার বিরূদ্ধে ধারাবাহিক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অনিবার্য পরিণতিতে আজ থেকে দুই শ উনষাট বছর আগে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পশ্চিম বঙ্গের ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আমবাগানে নবাবের বাহিনীর মুখোমুখি হয় ইংরেজ বাহিনী। যুদ্ধের নামে ভয়ংকর এক বিশ্বাস ঘাতকতার ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পরাজিত হন বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজ উদ-দৌলা। এই পরাজয়ের মধ্য দিয়ে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার শেষ সূর্য, যার মাশুল দিতে হয়েছে পরবর্তী ১৯০ বছর ধরে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবাব আলীবর্দী খাঁর পর ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল সিরাজ উদ-দৌলা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আসীন হন। তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। স্বাধীনচেতা ও টগবগে তরুণ নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের বিভিন্ন কারণে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।
এ ছাড়া, রাজ সিংহাসনের জন্য লালায়িত ছিলেন, সিরাজের পিতামহ আলীবর্দী খাঁর বিশ্বস্ত অনুচর মীর জাফর ও আপন খালা ঘষেটি বেগম। ইংরেজদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ স্থাপন করে নবাবের বিরুদ্ধে নীলনকশা পাকাপোক্ত করে। দিন যতই গড়াচ্ছিলো এ ভূখণ্ডের আকাশে ততই কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছিল। ১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল কলকাতা পরিষদ নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার পক্ষে প্রস্তাব পাস করে। এই প্রস্তাব কার্যকর করতে ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ রাজ দরবারের অভিজাত সদস্য উমি চাঁদকে এজেন্ট নিযুক্ত করেন।
এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়ক মীর জাফর, তা আঁচ করতে পেরে নবাব তাকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করে আব্দুল হাদীকে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু  কূটচালে পারদর্শী মীর জাফর পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করায় নবাবের মন গলে যায় এবং মীর জাফরকে প্রধান সেনাপতি পদে পুনর্বহাল করেন।
সমসাময়িক ঐতিহাসিকরা বলেন, এই ভুল সিদ্ধান্তই নবাব সিরাজের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজ কর্তৃক পূর্ণিয়ার শওকত জঙ্গকে সাহায্য করা, মীরজাফরের সিংহাসন লাভের বাসনা ও ইংরেজদের পুতুল নবাব বানানোর পরিকল্পনা, ঘষেটি বেগমের সঙ্গে ইংরেজদের যোগাযোগ, নবাবের নিষেধ সত্ত্বেও ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সংস্কার, কৃষ্ণ বল্লভকে ফোর্ট উইলিয়ামে আশ্রয় দান প্রভৃতি কারণে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশীর আমবাগানে সকাল সাড়ে ১০টায় ইংরেজ ও নবাবের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
মীর মদন ও মোহন লালের বীরত্ব সত্ত্বেও জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, উমি চাঁদ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ কুচক্রী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে নবাবের পরাজয় ঘটে। সেই সঙ্গে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য পৌনে দুই শ বছরের জন্য অস্তমিত হয়। পরাজয়ের পর নবাবের বেদনাদায়ক মৃত্যু হলেও উপমহাদেশের মানুষ নবাবকে আজও শ্রদ্ধা জানায়। তার সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল।  তাদের কারো স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। দেশমাতৃকার সাথে বিশ্বাসঘাতকরা অপঘাতে মৃত্যুর শিকার হয়েছিল সবাই।
ঐতিহাসিক মেলেসন পলাশীর প্রান্তরে সংঘর্ষকে যুদ্ধ বলতে নারাজ। তার মতে, নবাবের পক্ষে ছিল ৫০ হাজার সৈন্য আর ইংরেজদের পক্ষে মাত্র ৩ হাজার সৈন্য কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী ও কুচক্রী মীরজাফর, রায় দুর্লভ ও খাদেম হোসেনের অধীনে নবাব বাহিনীর একটি বিরাট অংশ পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কার্যত কোনো অংশগ্রহণই করেনি। এই কুচক্রীদের চক্রান্তে যুদ্ধের প্রহসন হয়েছিলো।
ইতিহাসবিদ নিখিল নাথ রায়ের লেখা মুর্শিদাবাদ কাহিনী থেকে জানা যায়, নবাবের সেনা বাহিনীর তুলনায় ইংরেজদের সেনা সংখ্যা ছিল অনেক কম। সেখানে বিশ্বাসঘাতকতা না হলে নবাবের বিজয় ছিল সুনিশ্চিত।
আরেক ঐতিহাসিক ড. রমেশ চন্দ্র বলেন, নবাব ষড়যন্ত্রকারীদের গোপন ষড়যন্ত্রের কথা জানার পর যদি মীর জাফরকে বন্দি করতেন, তবে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারী ভয় পেয়ে যেত এবং ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলে পলাশীর যুদ্ধ হতো না।
ইতিহাসবিদ মোবাশ্বের আলী তার বাংলাদেশের সন্ধানে লিখেছেন, নবাব সিরাজ উদ-দৌলা প্রায় লাখ সেনা নিয়ে ক্লাইভের স্বল্পসংখ্যক সেনার কাছে পরাজিত হন মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়। অতি ঘৃণ্য মীর জাফরের কুষ্ঠরোগে মৃত্যু হয়। ঘষেটি বেগমের মৃত্যু হয় বুড়িগঙ্গায় ডুবে। পররাজ্যলোভী নাটের গুরু লর্ড ক্লাইভ ক্ষুর দিয়ে গলা কেটে আত্নহত্যা করে। বিশ্বাসঘাতক, ষড়যন্ত্রকারী, পররাজ্যলোভী মীর জাফর, জগৎ শেঠ, লর্ড ক্লাইভ ও ঘষেটি বেগমদের সুযোগ সন্ধানী  প্রেতাত্নারা কিন্তু এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশ্বব্যাপী। চোখকান একটু খোলা রাখলেই আমাদের চারপাশে এদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস টের পাওয়া যাবে। এদের কারনে যেন আর কোন দেশ ও জাতির স্বাধীনতা বিপন্ন না হয়। পলাশীর বিয়োগান্তক ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছুই। ক্ষমতালোভী মীর জাফর ও তার দলবল দু’দিনের নবাবীর বিনিময়ে আজীবনের জন্য পেয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার দুনিয়াজোড়া খেতাব, মৃত্যুর পরেও যা মুছে যায়নি। এ থেকে শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছুই।
============================
আতিকুর রহমান মানিক,

ফিশারীজ কনসালটেন্ট, সংবাদকর্মী ও সংগঠক।
ই মেইল – [email protected]

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...

একটি ফুল—

একটি ফুল, একটি ফুলের জন্যে কতো নিষ্পাপ গাছ প্রাণ হারালো, এই বর্বর শুকোনের দল বারংবার ...