প্রকাশিত: ১৭/১১/২০২০ ৮:০৪ পিএম

ইংরেজি Narcissistic Personality Disorder আর বাংলায় আত্মমুগ্ধতাসূচক ব্যক্তিত্ব ব্যাধি বলা হয়ে থাকে। সংক্ষেপে এটাকে NPD বলে।

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে “আপনাকে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যাকে বড় বলে বড় সেই হয়।” কিন্তু NPD হচ্ছে এই প্রবাদের সম্পূর্ণ বিপরিত চিত্র। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যাক্তি নিজেকে অনেক বড় মনে করে। নিজের মধ্যে এতটাই আত্মবিশ্বাস জন্মে যায় যে কারো কোন পরামর্শ বা বুদ্ধি তার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। এখানে নিজেকে তিনি সেরা মনে করেন। এধরনের ব্যাক্তিদের মধ্যে হিংসাত্মক মনোভাব দেখা দেয়।

আত্মমুগ্ধতাসূচক ব্যক্তিত্ব ব্যাধির (NPD) লক্ষণ সমূহ:

কারো আত্মরতিমূলক ব্যক্তিত্ব ব্যাধি (NPD) নির্ণয়ের জন্য তার ভেতরে নিচের লক্ষণগুলি উপস্থিত থাকতে পারে:

১. আক্রান্ত ব্যাক্তি আত্ম-গুরুত্ব নিয়ে বিরাট একটা ধারণা রাখে (যেমন, সমানুপাতিক সাফল্য ছাড়াই নিজের সফলতা বা মেধা নিয়ে অত্যুক্তি করা এবং শ্রেষ্ঠতর হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার প্রত্যাশা করা)।

২. অন্যদের কাছ থেকে সম্মান ও আনুগত্য পাবার ঝোঁক: এটা প্রবল আকারে দেখা যায় আক্রান্ত ব্যাক্তির মধ্যে। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যাক্তিকে দাম্ভিক হতে দেখা যায়। সবসময় সবার থেকে আলাদা একটা সম্মান বা আনুগত্য পাবার একটা প্রবল ইচ্ছে থাকে সব সময়। আক্রান্ত ব্যাক্তি নিজেকে সবার থেকে আলাদা ভাবে এবং শ্রেষ্ট মনে করে। নিজের থেকে কম যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে।

৩. নিজের অর্জন এবং প্রতিভা অতিরঞ্জিত: এই ধরনের আক্রান্ত ব্যাক্তিরা একটু মেধাবী হয়। সে ক্ষেত্রে জীবনের অর্জন বা প্রতিভা দিয়ে সর্বদা দাম্ভিকতা দেখায়। এছাড়া শৈশব, কৈশরের অর্জিত অর্জন এবং প্রতিভা দাম্ভিকতা নিয়ে সারাজীবন চলতে চায়।

৪. বিশাল সাফল্য, শক্তি, প্রতিভা, সৌন্দর্য, বা প্রেমের কল্পনায় আচ্ছন্ন থাকা।

৫. নিজেকে “বিশেষ” ও অনন্য ভাবা এবং শুধু অন্য ‘বিশেষ’ বা উচ্চ-মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ (বা প্রতিষ্ঠান) তাকে বুঝতে পারে অথবা তাদের সাথেই তার মেশা উচিত বলে বিশ্বাস করা।

৬. অন্যের মনোভাব, অনুভূতি, কথা বা সমালোচনার প্রতি চরম অসহিষ্ণুতা: আক্রান্ত ব্যাক্তি অন্যের মনোভাব, অনুভূতি, কথা বা সমালোচনার প্রতি চরম অসহিষ্ণুতা বা ধৈর্যহীন বলা যায়। অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যাক্তি অন্যের কোন কথার গুরুত্ব দিতে চায়না। অন্যের অনুভুতিও কখনও বুঝতে চায়না। এছাড়া সমালোচনা একদমই সহ্য করতে পারেনা। নিজেকে সকল বিষয় সঠিক ভাবার একটা স্বার্থপর মনোভাব এদের মাঝে দীর্ঘদিন থেকে যায়। কারো কারো আজীবন। এদেরকে ভাল কিছু বুঝাতে গেলে বা তাদের ভুলের সমালোচনা করতে গেলে এরা সবসময় সেই খোড়া যুক্তি অনুসরন করবে। যেমন আপনি এই রকম আক্রান্ত ব্যাক্তিকে তার ভুলগুলো বা কিছু বিষয় বুঝাতে গেলেন সে তখন আপনাকে উত্তর দিবে, “আমার ভুল ধরার আগে নিজের ভুল গুলো শুধরে আসো।”

এধরণের মনোভাব পোষণকারীরা অন্যের সমালোচনা যেমন নিতে পারেনা, তেমনি কোনোবিষয়ে তাদের চিন্তার বাইরে অন্যদের কার কেমন চিন্তা বা অভিমত তাও তারা শুনতে নারাজ থাকে। অথচ এটা জরুরী না যে একটা মানুষ সবসময়ে সবক্ষেত্রে সঠিক থাকবে। এরা কখনো তর্কে হারতে চায়না, শত যুক্তি উপস্থাপন করা সত্বেও আর কখনো নিজের ভুলও স্বীকার করেনা। ফলে এধরণের মনোভাব যেমন এদের নিজের জন্যে ক্ষতিকর হয়, তেমনি তা অন্যদের জন্যেও অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় অনেকসময়।

৭. অত্যধিক প্রশংসা পাওয়ার তীব্র বাসনা: পূর্বেই বলা হয়েছে এই ধরনের আক্রান্ত রোগীরা একটু বেশিই মেধাবী হয়ে থাকে। একারনে সবসময় প্রশংসা পাওয়ার একটা তীব্র বাসনা জেগে থাকে। সব রকম কাজে সে প্রশংসা প্রত্যাশা করে। লক্ষ্য এবং উদ্দ্যেশ্যই থাকে অন্যের প্রশংসা কুরানো।

৮. অবাধ্যতা: NPD আক্রান্ত রোগীরা প্রচন্ড অবাধ্য। এই সমস্যাটা তাদের মধ্যে তীব্র আকারে দেখা যায়। আপনি যদি দেখেন যে আক্রান্ত ব্যাক্তি যা করছে তা ভুল করছে বা তা ক্ষতির কারণ হচ্ছে আপনি তার চিন্তার বিপরীতে কোন কিছুই বঝাতে পারবেননা। আপনি যুক্তি দেখিয়ে বুঝাতে বুঝাতে হাপিয়ে উঠবেন তাও এরা নিজের কথায় অটল থাকবে।

আপনি যে বিষয়ে পটু সে বিষয়েও তারা আপনার চাইতে বেশি বিজ্ঞতা দেখাতে চাইবে সম্যক জ্ঞান না থাকা সত্বেও। এমনকি অনেকসময় এরা শিক্ষক, চিকিৎসক, গুণী ব্যক্তি, বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞদের কথাতেও পাত্তা দেয়না। সব বিষয়ে নিজেকে খুব সমঝদার মনে করার একটা ভ্রান্ত ধারণা জেঁকে থাকে এদের মাঝে। ফলে অন্য কেউ ভালোর জন্যে কিছু বললে সেটাতে এরা অবজ্ঞা ভরে অবাধ্যতা দেখায়।

৯. সমস্ত কিছুর সর্বোত্তম থাকার উপর জোর: NPD আক্রান্ত ব্যাক্তির মধ্যে আরো একটি সমস্যা দেখা দেয় সেটা হলো সেরা বা সর্বোত্তম থাকার উপর জোর দেয়া। অর্থাৎ এই ধরনের ব্যাক্তিরা প্রতিটা বিষয় সেরা থাকার উপর জোর দেয়। যেমন ধরুন, দামি গাড়ি, বাসার দামি সোফা, দামি জামা ইত্যাদি।

আত্মরতিমূলক ব্যক্তিত্ব ব্যাধি কারন: নারকিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের কারণ সমূহ এখনও সবগুলো জানেনা গবেষকরা। তবে তারা সম্ভাব্য কতগুলো কারন নির্ণয় করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

জৈবিক এবং জেনেটিক কারণ: গর্ভাবস্থায় বিকাশজনিত কোনো কারণে এমন কিছুর প্রভাব পরবর্তী জীবনে ঘটে থাকতে পারে। অপরদিকে অন্য আরেকটি জৈবিক কারণস্বরূপ কোনধরনের স্নায়বিক সমস্যা, মস্তিষ্কের আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়ায় কোনো সমস্যার দরুণও এমনটা হতে পারে।

সামাজিক ও পারিবারিক কারণ: NPD আক্রান্ত ব্যাক্তিদের উপর গবেষনা করে দেখা গেছে যে এই রোগরে জন্য সামাজিক ও পারিবারিক একটি বড়সর কারণ। শিশু বয়সে মাত্রাতিরিক্ত আহলাদ পাওয়া। মেধাবী হওয়ায় সামাজিকভাবে অতিরিক্ত বাহবাহ পাওয়ায় ব্যাক্তির মধ্যে একটি অতিরিক্ত মাত্রার কনফিডেন্স তৈরি হয়ে যায়। যার করনে পরবর্তি সময় ব্যাক্তির মধ্যে অহংকার,ক্রোধ সহ নানা রকম সমস্যার তৈরি হয়। এছাড়া শিশুবয়সে না বিচারে ন্যায়, অন্যায়, ভুল ও সঠিক সব কাজেই সায় দিয়ে বড় করা। আবার পক্ষান্তরে সমালোচনার শিকার হওয়া, সমাজে অনেকের কাছে ব্যাঙ্গর মুখোমুখি হওয়াটাও এটার কারণ হতে পারে।

কখন ডাক্তারের সাথে দেখা করতে হবে: NPD তে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা কোনভাবেই এই ধরনের সমস্যা সমূহকে রোগ বলতে নারাজ। তারা এতটাই আত্মবিশ্বাসি থাকে যে তাদের ভুল হতে পারে সেটা অসম্ভব। একারনে তাদের চিকিৎসা নেয়ার সম্ভাবনা কম। যদি কেউ চিকিৎসা নিতেও যায় তাহলে তারা সম্ভাবত হতাশা, ড্রাগ বা অ্যালকোহল ব্যবহার, বা অন্য কোনও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণগুলির জন্য যাবে।

আত্ম মর্াদাবোধের অপমানের কারণে এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা চিকিৎসা নিতে চায়না।

NPD এর চিকিৎসা: যেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে নিজের বিশ্বাসের প্রতি প্রচন্ডরকমের অহংবোধ কাজ করে এবং যেহেতু তাদের মাঝে ঘুরে ফিরে নিজেদের সঠিক মনে করার প্রবণতাটাই কাজ করে, সেক্ষেত্রে একা কোনো থেরাপিস্ট এর পক্ষে এদেরকে সহজে নিজেদের ধারণার বাইরে কিছু বুঝানো অনেক কষ্টদায়ক, এবং অনেকাংশেই অসম্ভব।তাই এক্ষেত্রে গ্রুপ থেরাপি, মানে অনেকগুলো সাইকিয়াট্রিস্ট/কাউন্সিলর এর সম্মিলিত থেরাপি কার্যকর হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। এক্ষেত্রে অনেকেই Mentalization based therapy, transference-focused psychotherapy, ও schema-focused psychotherapy পদ্ধতিগুলোর প্রয়োগ সমর্থন করে থাকেন।

আমাদের করনীয়: নারকিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারটি প্রায়শই শুরু হয় কৈশোরে বা যৌবনের শুরুতে। এই ধরনের রোগীর আচরণ যদি বাড়াবাড়ি পর্ায় চলে যায় তাহলে প্রথম কাজ হবে রোগীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বা ভুলিয়ে ভালিয়ে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া।

এছাড়াও ব্যক্তিটির পরিবার, স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও কাছের মানুষদের সম্মিলিত সমর্থন, মানবিক সাহায্য একান্ত প্রয়োজন রোগীর জন্য। সঠিকভাবে সুদীর্ঘ থেরাপির মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যাক্তিকে সুস্থ করে বের করে আনা সম্ভব এই জঘণ্য আচরণ থেকে।

[Dr. John Grohol, founder and Editor-in-Chief of Psych Central ও ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে লেখাটি সম্পূর্ করা হয়েছে।]

লেখক: আমিরুল ইসলাম
বিএসসি (মনোবিজ্ঞান), এমএসসি (ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি),
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

©bd24live

পাঠকের মতামত

একটি পেঁয়াজের ওজন ৯ কেজি

বিশ্বের সবচেয়ে বড় পেঁয়াজ ফলাতে সক্ষম হয়েছেন ব্রিটিশ এক কৃষক। গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ...