প্রকাশিত: ২২/০৭/২০১৭ ২:০৭ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৪:২৭ পিএম

এইচএম এরশাদ::

মিয়ানমারে উৎপাদিত মরণনেশা মাদক ইয়াবার আগ্রাসন রোধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নাফ নদীতে জেলেদের মাছ ধরা সাময়িক বন্ধ রাখার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ নির্দেশ কার্যকরে সিভিল, পুলিশ ও বিজিবি প্রশাসন একযোগে তৎপর হয়েছে। ইতোমধ্যে নাফ নদীতে নিয়মিত মৎস্য শিকার করে থাকে এমন জেলেদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এর সংখ্যা ৩ সহ¯্রাধিক বলে টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন সিদ্দিক শুক্রবার জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন, আপাতত রাতেরবেলা মৎস্য শিকার বন্ধ রাখার চিন্তাভাবনা হয়েছে। দিনেরবেলা উন্মুক্ত থাকবে। পুরো বিষয়টি সমন্বিত বৈঠকে চূড়ান্ত করা হবে।

উল্লেখ্য, টেকনাফ থেকে উখিয়ার বালুখালি পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার বিস্তৃত নাফ নদীর মধ্যবর্তী স্থান থেকে সীমারেখা বিভাজিত হয়ে আছে। উভয় অংশে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মৎস্য শিকারীরা স্ব স্ব সীমানায় থেকে মৎস্য শিকার করে থাকে। সাধারণত চিংড়িসহ সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য ধরা পড়ে বিহিন্দী জালে। রাতেরবেলায় এ জাল ফেলে রাখা হয়। সকালবেলা তা উঠিয়ে মাছ তোলা হয়। এদিকে, কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান জানিয়েছেন, ইয়াবার ভয়াল আগ্রাসন রোধে স্থানীয় পর্যায়ের সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণের পর প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ নির্দেশনা দিয়েছেন। ঠিক ক’দিনের মধ্যে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন হবে তা সহসা চূড়ান্ত হবে। নাফ নদীতে মৎস্য শিকার বন্ধের এমন নির্দেশনার পর সংশ্লিষ্ট জেলেদের ভিন্নভাবে বা কীভাবে পুনর্বাসন করা যায় তা নিয়েও চিন্তাভাবনা চলছে।

এই বিষয়ে টেকনাফ ২বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক আরিফুল রহমান টেকনাফনিউজকে জানান বিজিবির বিওপি ভিত্তিক জেলেদের তালিকা করা হচ্ছে তালিকা করা শেষ হলে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যেমে জানানো হবে আগামী কত তারিখ থেকে নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ করা হবে।প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিজিবি মাঠে ময়দানে কাজ করে যাচ্ছে,যাতে কোন জেলে প্রতারনা ও হয়রানি শিকার না হয় ।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্রদান করলেও ইয়াবার চালান আসা রোধ করা যাচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবার বিজিবির অভিযানে টেকনাফের হোয়াইক্যং এলাকায় আটক হয়েছে ৩ কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে ৯৭ হাজার পিস ইয়াবা। অপরদিকে, একই দিনে সাতকানিয়া ও পটিয়ায় হাইওয়ে পুলিশের অভিযানে প্রাইভেটকারের গ্যাস সিলিন্ডারযোগে আনা ২০ হাজার ইয়াবা আটক হয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের মংডু ও সিটওয়ে থেকে সমুদ্রপথে ইয়াবার বড় বড় চালান আসছে অহরহ। এসব চালান চট্টগ্রাম, পতেঙ্গা, বাঁশখালি, আনোয়ারা, কুতুবদিয়া, চকরিয়াসহ বিভিন্ন পয়েন্টে সুযোগ বুঝে খালাস করা হয়। এছাড়া ইঞ্জিনচালিত বোটে সরাসরি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায়।

ইয়াবার আগ্রাসন যে মহামারি রূপ নিয়েছে তা নিয়ে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রকাশ্যে বলেছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংস্থাগুলো ইয়াবা চোরাচালান চক্রের সদস্যদের সঙ্গে কোনভাবেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না। মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় সুনির্দিষ্টভাবে যে ৩৭টি ইয়াবা উৎপাদন কারখানার কথা বলা হয়েছে সেগুলো বন্ধের জন্য বাংলাদেশের পক্ষে যে সুপারিশ পেশ করা হয়েছে এ নিয়ে কোন সুফলতা আসেনি, বরং প্রতিনিয়ত বৃদ্ধিই পাচ্ছে। ২০১১ সালের ১৫ ও ১৬ নবেম্বর মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে এবং ২০১৫ সালের ৫ ও ৬ মে ঢাকায় উভয় দেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মহাপরিচালক পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ইয়াবার উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধে মতৈক্য সৃষ্টি হয়। কিন্তু এ মতৈক্য বাস্তবে কোন রূপ নেয়নি। প্রতিনিয়ত কি পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেট মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন চোরাপথে আসছে এর কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০১০ সালে ইয়াবা আটকের সংখ্যা ছিল ৮ লাখ। ২০১৫ সালে ধরা পড়ে ২ কোটিরও বেশি। ২০১৬ সালে তা ৩ কোটি ছাড়িয়ে যায়। চলতি বছর শেষে এ পরিমাণ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এ নিয়ে শঙ্কিত অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবাসহ মরণনেশা মাদক বন্ধে ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনীর মাধ্যমে সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদ-ের বিধান করার সুপারিশ করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এ নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। প্রসঙ্গত, বিদ্যমান আইনে মাদকদ্রব্য পরিবহনে ২ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, টেকনাফ ও উখিয়া অঞ্চলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ইয়াবা চোরাচালানীর আধিক্য রয়েছে। এরা একদিকে জনপ্রতিনিধি হয়ে মাদকবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে, পক্ষান্তরে নেপথ্যে এরাই ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক চোরাচালান তৎপরতায় বিনিয়োগ করে তা বাজারে আসতে সহায়তা করে যাচ্ছে। মাদকের মধ্যে ইয়াবা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধেও অভিযোগের কমতি নেই। ইয়াবা আকৃতিতে ছোট হওয়ায় এর চালান পরিবহনে সহজ। অপরদিকে, অতিসহজে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ উপার্জনের পথটিও সুগম হয়ে যায়। ফলে মোটা অঙ্কের অর্থের লোভ যারা সামলাতে অপারগ এরা এ পথে পা বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে শরণার্থী বা আশ্রিত হয়ে থাকা রোহিঙ্গারা অন্যান্য কর্মকা- বাদ দিয়ে ইয়াবা চালানের দিকেই বেশি আসক্ত। কেননা, শুধু নিজ উদ্যোগে পরিবহন করে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারলেই মোটা অঙ্কের অর্থ পাওয়া যায়। ফলে ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে রোহিঙ্গা ও কথিত জনপ্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্টতা বেশি বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন রিপোর্টে উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞ সূত্রে জানানো হয়েছে, দেশের তরুণ সমাজের বড় একটি অংশ ইয়াবা সেবনের প্রতি প্রতিনিয়ত ঝুঁকছে। যা আগামীতে বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। সিউড্রো এফিড্রিন নামের রাসায়নিক দিয়ে প্রস্তুত ইয়াবা ট্যাবলেট সেবন করে যুব সমাজকে ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখী করছে তা নিয়ে তাদের যেন কোন শঙ্কাই নেই।

ইয়াবার অন্যতম কাঁচামাল সিউড্রো এফিড্রিন আমদানি এবং এ রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে প্রস্তুত যে কোন ধরনের ওষুধ প্রস্তুতকরণ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। কিন্তু এ সিউডো এফিড্রিন মিয়ানমারের অসাধু চক্র কিভাবে আনছে এবং তা দিয়ে উৎপাদিত ইয়াবা বাংলাদেশে প্রেরণ করছে ৯০ সালের পর থেকে। এর আগে ইয়াবার নামও এদেশে শোনা যায়নি। বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর এনসিডি কন্ট্রোল এ্যান্ড প্রিভেনশন নামের সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে; বিষয়টি নিয়ে তারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করেছে। এর ভয়াবহতার সার্বিক দিক অবহিত করেছে। তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ড্রাগ এডিকশন হেরোইন, ইয়াবাসহ মরণনেশা মাদক বন্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প পথ নেই। বর্তমানে ইয়াবার আগ্রাসন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে সরকার নানামুখী চিন্তাভাবনা করছে যার মধ্যে নাফ নদীতে জেলেদের মাছ ধরা বন্ধের নির্দেশনার বিষয়টি অন্যতম। পাশাপাশি এ জাতীয় মাদকের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-ের বিধান করার চিন্তাভাবনাও চলছে। দেশে ইয়াবা পাচার হয়ে আসার প্রধান রুট নাফ নদী এবং তা মৎস্য শিকারীদের ব্যবহৃত বিভিন্ন নৌযানের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে থাকে। পাশাপাশি সমুদ্রপথেও এর চালান আসছে এবং নদী ও সমুদ্রপথে হাজার হাজার ইঞ্জিনচালিত নৌযান বন্ধ করার সুযোগ যেখানে নেই সেখানে আইনের কঠোর বিধান চালু করা ছাড়া বিকল্প কোন পথও খোলা নেই।

পাঠকের মতামত

সোনার দামে আবারও রেকর্ড, ভ‌রি‌ ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৩৮ টাকা

আবারও সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। প্রতি ভরিতে ...