প্রকাশিত: ২৪/০৯/২০১৮ ৭:৪২ এএম

জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল তথা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ বলবৎ হলে সংবাদকর্মীদের তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞ, সাংবাদিক ও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এ আইনের ৩২ ধারার কারণে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রথা ধ্বংস হয়ে যাবে। এই ধারার ব্যাখ্যা অনুযায়ী অনুমোদন ছাড়া সরকারি কোনো দপ্তর বা সংস্থার তথ্য সংগ্রহ করলে তা গুপ্তচরবৃত্তি বলে বিবেচিত হবে। আইনে এই ব্যবস্থা রাখাটা শুধু শাসনব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিরুদ্ধে নয়, কার্যত দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের পথকেই প্রশস্ত করেছে।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হওয়া বিলটি এখন শুধু রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিলেই আইনটি কার্যকর হবে। এর আগে ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভা আইনটির অনুমোদন দেয়। এরপর ব্যাপক সমালোচনা হয় আইনটি নিয়ে। বিশেষ করে এই আইনকে স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সাংবাদিকসমাজ ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন আইনের ৩২ ধারা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কিন্তু কোনো পরিবর্তন না করেই সংসদে পাস করা হলো আইনটি। শুধু তা-ই নয়, শেষ মুহূর্তে এই আইনে নতুন একটি ধারা সংযোজন করা হয়েছে। নতুন সংযোজন করা ৪৩ ধারায় পুলিশকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

দেশে সাইবার অপরাধ যেভাবে বাড়ছে তাতে সেই অপরাধ দমন করতে একটি কঠোর আইনের প্রয়োজনীয়তা সবাই স্বীকার করেন। তবে সাংবাদিকদের সুরক্ষা দিয়েও তা করা যেত বলে মনে করেন আইনজ্ঞ ও সাংবাদিকরা। পাস হওয়া আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে।’ আইনে এ অপরাধের শাস্তি হিসেবে ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। গণমাধ্যমকে এই আইনে কোনো সুরক্ষা দেওয়া হয়নি।

২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারায়ও অনেকটা একই রকম বিধি-নিষেধ ছিল। এরই মধ্যে এর অপব্যবহারও হয়েছে ব্যাপক। ওই ধারায় উল্লেখ ছিল, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ফরম বা ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন কিংবা যার মাধ্যমে মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এই ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে অপরাধ।’ ২০০৬ সালে প্রণীত এই আইনটি সংশোধন করা হয় ২০১৩ সালে। ওই ধারায়ও অপরাধীর শাস্তি ছিল ১৪ বছরের কারাদণ্ড।

জানা যায়, ২০১২ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত আইসিটি আইনে মামলা হয় প্রায় এক হাজার ৭০০। ওই সব মামলার ৬৫ শতাংশই হয়েছিল ৫৭ ধারায়। সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধেও প্রচুর মামলা হয়। গণমাধ্যমকর্মীরা বিষয়টি নিয়ে বারবার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পর সরকারের পক্ষ থেকে ধারাটি বাতিল করার আশ্বাস দেওয়া হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হবে ঠিকই, তবে তার চেয়েও কঠোর বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনের ৩২ ধারায়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডিজিটাল আইনের ৩২ ধারার কারণে অনুমোদন ছাড়া সরকারি দপ্তরের তথ্য সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। অথচ কোনো দপ্তরের দুর্নীতির তথ্য সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমকর্মীরাই উদ্ঘাটন করে থাকেন। এখন সরকারি, আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করতে যদি অনুমতি নিতে হয় তাহলে ওই তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কোনো ব্যাংক বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যদি দুর্নীতির অভিযোগ থাকে তাহলে তাঁরা তথ্য দেবেন না, এটাই স্বাভাবিক। কোনো আদালতে মামলার নথি দেখাও এই আইনের কারণে বাধাগ্রস্ত হবে বা বিচারকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তা যাচাই করা যাবে না।

এই আইনে নতুন সংযোজন করা ৪৩ ধারায় পুলিশকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যদি একজন পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন এই আইনের অধীনে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে অথবা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে অপরাধটি করা হয়েছে অথবা এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের সম্ভাবনা রয়েছে অথবা সাক্ষ্য-প্রমাণ বিনষ্টের সম্ভাবনা রয়েছে, তবে পুলিশ যেকোনো স্থানে বা ব্যক্তিকে তল্লাশি করতে পারবে। এই বিধানের সুবাদে পুলিশ ইচ্ছা করলেই যেকোনো ব্যক্তিকে হয়রানি করার সুযোগ পাবে। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া কাউকে হয়রানি করা হলেও তার সুরক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি আইনে।

বিশিষ্ট আইনজীবী ও হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি রাষ্ট্র ও সংবাদকর্মীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি তথ্য ফাঁস হওয়া যেমন সরকারের জন্য বিব্রতকর, আবার সংবাদ সংগ্রহ না করতে পারাও সংবাদকর্মীদের জন্য বিব্রতকর। দুর্নীতির তথ্য যদি সংবাদকর্মীরা সংগ্রহ করতে না পারেন তাহলে তা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী বিষয় হবে। আর আইনের যে ধারাটি স্বাধীন মত প্রকাশের অন্তরায় তা সংবিধান পরিপন্থী। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত। তাঁরা চাইবেন না তাঁদের দুর্নীতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হোক। এ কারণে অনুমতি তাঁরা দেবেন না এটাই স্বাভাবিক। কাজেই গণমাধ্যমকে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি তুলে ধরতে বাধাগ্রস্ত করা হলে দুর্নীতি তো বাড়বেই। আর এটা জনস্বার্থের পরিপন্থী।

মনজিল মোরসেদ আরো বলেন, ‘এমন একটা আইন প্রয়োজন ছিল। সাইবার অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ায় সবাই উদ্বিগ্ন ছিল। কিন্তু সাংবাদিকদের সুরক্ষা না দিয়ে আইন করাটা যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ হয়েছে সাংবাদিকদের ওপর। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার অপপ্রয়োগও মারাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা করা যায়।’

কোর্ট রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা ও ফৌজদারি মামলা পরিচালনাকারী বিশিষ্ট আইনজীবী সৈয়দ আহমেদ গাজী বলেন, ‘খবরের পেছনেই সাংবাদিকরা কাজ করেন। তথ্য পেলে তাঁরা তা প্রকাশ করেন। গণমাধ্যমের ভূমিকার জন্যই দেশে দুর্নীতির হার কমছে। কিন্তু ওই তথ্য সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হলে দুর্নীতি বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। জনস্বার্থবিরোধী হয়েছে এই ৩২ ধারা।’

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অপসাংবাদিকতা রোধের জন্য আইনের প্রয়োজন রয়েছে। সঠিক ও সত্য সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশ তো কোনো অপরাধ হতে পারে না। ৩২ ধারায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহকে গুপ্তচরবৃত্তি হিসেবে আখ্যা দিয়ে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করা হয়েছে, তা উদ্বেগের কারণ। এই ধারার অপপ্রয়োগ হওয়ার সুযোগ আইনেই রয়েছে। আর অপপ্রয়োগ হলে তা হবে ৫৭ ধারার চেয়েও খারাপ।’

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে নতুন আইনটিতে যেসব অসামঞ্জস্য রয়েছে সেগুলো দূর করার আহ্বান জানিয়েছে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব করা তিনটি সংগঠন। সাংবাদিক সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজ আনাম, অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্সের (এটকো) সহসভাপতি মোজাম্মেল বাবু ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। এই প্রতিনিধিরা গত শনিবার এক যৌথ বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গণমাধ্যমকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়নি। তথ্য অধিকার আইন ও অফিশিয়াল সিক্রেসি আইনের পাশাপাশি অবস্থান নিশ্চিত করে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশকে অবাধে ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দিয়ে স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করার পথ সুগম করা হয়েছে। তাঁরা বলেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এই আইনের অপপ্রয়োগের বিষয়টি নিয়েও উৎকণ্ঠিত।’

বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। বিলে সই না করতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছে সংগঠনটি। সিপিজে মনে করে, এই আইন বলবৎ হলে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার যে নিশ্চয়তা সংবিধান দিয়েছিল, তা খর্ব হতে পারে। এ ছাড়া সংবাদকর্মীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সাধারণ কার্যক্রম অর্থাৎ তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ভয়াবহ ‘আইনি আপদ’ সৃষ্টি করবে।

পাঠকের মতামত

পবিত্র ঈদুল ফিতর আজ

‘ঈদ এসেছে দুনিয়াতে শিরনি বেহেশতী/দুষমনে আজ গলায় গলায় পাতালো ভাই দোস্তি’- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ...