প্রকাশিত: ১২/০৫/২০১৭ ৯:০৭ এএম

তাসমিয়া রহমান খান|
রুপমা (ছদ্ম নাম) পেশায় একজন শিক্ষক, সকালেই ঘুম থেকে উঠে কফির মগ হাতে নিয়ে কম্পিউটার মনিটর খুলতেই স্বনামধন্য নিউজ পোর্টালে দেখতে পেলেন, ‘চার বছর বয়সী শিশু ধর্ষণ’।

মগ ভর্তি ব্ল্যাক কফি, সকালের বিশুদ্ধ পাপহীন বাতাস এবং কফির ক্যাফেইন কোনটাই কিশোরী বয়সের স্মৃতি থেকে রুপমাকে ফিরিয়ে আনতে পারছে না।

শরীরে কাঁপুনি দিয়ে সেই ঘৃণ্য স্পর্শগুলো পুরো শরীরে আবারও নীল ক্ষত হয়ে ফুটে উঠছে, কখনো সাপ তো কখনো অজানা নির্লজ্জ কোন সরীসৃপ। দেহের কোষগুলোও সেই ভয়ানক স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। মনে পড়ছে মা ও সেদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে কেঁদেছিলেন।

শুনেছি পশুকে হাসার ক্ষমতা প্রকৃতি দেয়নি, তাহলে কারা হাসছে? মানুষ? নাকি পশু? মনে হচ্ছে এরা ‘মাপশু’। না আর ভাবতে পারছি না। ওপাশ থেকে কেউ বলল, ‘এ কি অবস্থা তোমার, তুমি এত ঘামছ কেন? আবার ওসব ভাবছ?’

রুপমা বর্তমানে ফিরে এলেন, কফি ততক্ষণে ঠান্ডা। প্রশ্ন হলো, মস্তিষ্ক কি সেই ভয়ানক দাবানলরূপী স্মৃতিগুলোকে বন্ধ করে দেয়?

প্রশ্নটা অন্য কেউ না নিজেকে সেখান থেকে কতটুকু দূরে রাখা যায়?

উত্তর না! না! না!

আচ্ছা, যখন কোন ছিনতাইকারি বা মলম বাহিনী জোরপূর্বক আপনাকে আহত করে আপনার শখের মোবাইল ফোন অথবা অর্থ সম্পদ লুট করে তাদের নেশার খোরাক যোগায়, আপনি সেই স্মৃতি কতটুকু ভুলে যাবেন?

ধর্ষণ সমাজে ঘটে যাওয়া সে সকল স্মৃতির সাথে অপরিমেয়। ধর্ষণ শুধু শরীরের না, মনের দাগ, সে সাথে সমাজের একটা Live বৃদ্ধাঙ্গুলির চিহ্ন।

তবে দায় কি শুধু নারীর? না সমাজের?

ঘুরে ফিরে কথা সমাজেই আসে।

সমাজ খুব সুন্দর করে গর্বের সাথে চায়ের দোকানে অথবা কফি হাউসে বসে টকশো করে, পাড়ায় পাড়ায় অলিতে গলিতে আর বলে দোষ মেয়েদের। মেয়ে কেন ওড়না নিল না? কেন রাতে বাড়িতে দেরিতে এল? কেন ছেলে বন্ধু বানাল? কেনো পর্দা করলো না?

আচ্ছা আমার প্রশ্ন পর্দা কি শুধুই শরীরের?

জ্বি, পর্দা অবশ্যই প্রয়োজন, তবে প্রথমে মনের। পর্দা শরীরে না দেখিয়ে মনে সর্বস্তরে ঢালুন তাহলেই পর্দার অনুপাত হবে পুরুষ:নারী ৫০:৫০। লালসায় পর্দা আনতে হবে, পুরুষের মনের পর্দা, শারীরিক আকর্ষণে পর্দা।

প্রাকৃতিকভাবে পুরুষের শক্তি বেশি হওয়ায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে জোরপূর্বক কার্যসিদ্ধি করার প্রবণতা বেশি। হোক সেটা বিছানায়, কোন অফিস কক্ষে অথবা রাজপথে।

আপনাকে রেজিস্ট্রি করে জীবন সঙ্গী করেছেন, সংসার করছেন, তাকেও জোরপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করলে সেটাও ধর্ষণ এর তালিকায় পড়বে। প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে ধর্ষণ কী?

বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী পাঁচটি অবস্থায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলা যায়। সেগুলো হলো:

১. নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে

২. নারীর সম্মতি ছাড়া

৩. মৃত্যু বা জখমের ভয় দেখিয়ে

৪. নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানে যে, সে ওই নারীর স্বামী নয় এবং পুরুষটি তাও জানে, নারীটি তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে যে পুরুষটির সঙ্গে তার আইনসঙ্গতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে সে বিশ্বাস করে।

৫. নারীর সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যদি সে নারীর বয়স ১৬ বছরের কম হয়। অর্থাৎ ১৬ বছরের চেয়ে কম বয়সী মেয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।

প্রশ্ন আসতে পারে, ধর্ষিতা কে হতে পারে? শুধুই কি নারী?

জবাব হচ্ছে, ধর্ষক নারী-পুরুষ দুজনেই হতে পারে। একজন পুরুষ যখন অনিচ্ছাকৃত শারীরিক সম্পর্কের জোরপূর্বক স্বীকার হবেন, সেটাকে ধর্ষণ বলা হবে। বিভিন্ন দেশে কয়েদিদের হিস্ট্রি ঘাটলে দেখা যায়, তারাও ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে।

তবে সমাজে সেটা তাদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলেনি। কারণ সেখানে শারীরিক ক্ষমতার দিক দিয়ে অনুপাত ১:১। দুই পক্ষই প্রায় সমান বলের অধিকারী। দুঃখের বিষয়, তারাও অনেক ক্ষেত্রে থেকে যাচ্ছে নীরব।

ধর্ষণের পর সমাজের কারণে অথবা প্রভাবশালীদের ভয়- ভীতির কারণে কী করবেন বুঝতে পারেন না।

সেক্ষেত্রে ভয় না পেয়ে প্রথমেই আপনাকে যা করতে হবে তা হলো:

প্রথমত. ধর্ষণের পর নিকটস্থ কাউকে এ বিষয়ে জানানো। এবং যত দ্রুত সম্ভব থানায় এজাহার দায়ের করা।

দ্বিতীয়ত. ধর্ষণের প্রধান আলামত নারীর শরীর। তাই মেডিকেল পরীক্ষার আগ পর্যন্ত কিছুতেই গোসল করা যাবে না। শুধু মেডিকেল পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে ধর্ষণের শাস্তি দেয়া যায়। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের সময় যে পোশাক পরা ছিল তা ধোয়া যাবে না। এটিও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

তৃতীয়ত. যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থানায় এজাহার দায়ের করতে হবে, এবং মেডিকেল পরীক্ষাও খুব দ্রুত করতে হবে। কারণ, ঘটনা ঘটার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষা না করালে অনেক আলামত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

ভিকটিম ও প্রধান সাক্ষী: ধর্ষণের মামলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চাক্ষুষ সাক্ষী থাকে মাত্র একজন এবং সে ধর্ষণের শিকার নারী নিজেই। শুধু এই সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করেই অভিযুক্তকে আদালত অপরাধী হিসেবে শাস্তি দিতে পারেন। ফলে নারীর সাক্ষ্য নিয়ে যদি আদালতের কাছে কোনো সন্দেহ দেখা দেয়, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া পেয়ে যেতে পারেন।

যদি আদালতে দেয়া সাক্ষ্যের সঙ্গে জবানবন্দি বা এজাহারের কোনো পরস্পর বিরোধিতা থাকে তাহলে তা নারীর বিপক্ষে যাবে। আদালতে ধর্ষণের ঘটনা বর্ণনা করা অত্যন্ত বেদনার, কিন্তু অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনার জন্য এই কঠিন কাজটি করতে হবে।

মাথায় রাখুন, অপরাধ আছে তো শাস্তি ও আছে। আপনিও জানেন অপরাধী কে। শাস্তিও তার প্রাপ্য।

ধর্ষণের শাস্তি: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে:

ধারা ৯ (১): কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডও তাকে দেয়া যেতে পারে।

ধারা ৯ (২): ধর্ষণের ফলে বা ধর্ষণের পড়ে অন্য কোন কাজের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষণকারী মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করবেন। এছাড়াও তাকে এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

ধারা ৯ (৩): একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে এবং ধর্ষণের কারণে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে তাহলে ধর্ষকরা প্রত্যেকেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়াও তাদেরকে অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

ধারা ৯ (৪): যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে (ক) ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

(খ) যদি ধর্ষণের চেষ্টা করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

ধারা ৯ (৫): পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে কোন নারী ধর্ষিত হলে, যাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্ত ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, সে ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ উক্ত নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরি দায়ী হবেন এবং তাদের প্রত্যেকে অনধিক ১০ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

ধর্ষক হয়ত, ভাবেন এ দেশে আইনের শাসন বেশ সময়ের ব্যাপার। কিন্তু আসলেই কি তাই? না, সেই দিন এখন অতীত।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল: নারী ও শিশু নির্যাতন-সংক্রান্ত সব অপরাধের বিচারকাজ পরিচালনার জন্য সরকার প্রত্যেক জেলা সদরে একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নামক বিশেষ আদালত গঠন করেছে। ধর্ষণের বিচারও এই ট্রাইব্যুনালে হবে।

আমরা সবসময় যা দেখি, মামলা শেষ হতে অনেক দিন সময় নেয়। কিন্তু এই আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘মামলা প্রাপ্তির তারিখ হতে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।’ [নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ধারা ২০(৩)]

ধর্ষণ না, ধর্ষক কে দেখুন। ধর্ষিতা নয়, ধর্ষককে সমাজের কাঠগোড়ায় উঠিয়ে দিন। এটা শুধু ধর্ষিতার নয় আপনার আমার সমাজের দায়িত্ব। রাষ্ট্রকে সহায়তা করুন। অপরাধ আছে আইন ও আছে সেই সাথে শাস্তিও আছে। শুধু প্রয়োজন সাহসের।

সাহস নিয়ে এগিয়ে যান সামনে আমাদের পাবেন।

রুপমা হাঁটছে ঝড় আসবে বলে মনে হচ্ছে তার পাশে একটি ছায়া। নাহ, বেশ কিছু ছায়া। কিন্তু তিনি ভয় পাচ্ছেন না। কারণ, তার ছায়া তাকে খুঁজে নিয়েছে। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সাহস দিয়েছে ভরা পূর্ণিমায় এক সাথে হেঁটেছে। অমাবস্যায় একলা চলার সাহস দিয়েছে। জীবনে আর কি লাগে যদি দুঃস্বপ্নের সময় সে থাকে? ভালোবাসা থাকে। সে মনে মনে বলছে, ‘ঝড়ো বাতাস কে কোরো না ভয়। এই বাতাস কেই করো জয়।’

লেখক: আইনজীবী ও রেডিও জকি

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...

একটি ফুল—

একটি ফুল, একটি ফুলের জন্যে কতো নিষ্পাপ গাছ প্রাণ হারালো, এই বর্বর শুকোনের দল বারংবার ...