মির্জা মেহেদী তমাল, টেকনাফ (কক্সবাজার) থেকে ফিরে
টেকনাফের পুরান পল্লানপাড়া পাহাড়। দেখে শান্ত স্নিগ্ধ মনে হলেও শান্তি নেই এই জনপদে। আছে ভয় আর আতঙ্ক। পাহাড় ঘেঁষে রয়েছে অসংখ্য গ্রাম।
গ্রামগুলোর মানুষ দিনের আলোয় চলাচল করলেও রাতে সবাই থাকেন একসঙ্গে। কারণ পাহাড়ে আছে ভয়ঙ্কর হাকিম। যিনি হাকিম ডাকাত নামে পরিচিত।
মিয়ানমারের বিদ্রোহী এই নেতা আবদুল হাকিম প্রকাশ ওরফে হাকিম ডাকাত যখন তখন নেমে আসতে পরে। কারণ রাতেই এরা তৎপর। গ্রামের বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে তুলে নিয়ে যায় গ্রামবাসীদের। মুক্তিপণের টাকা না পেলে পড়ে থাকে তাদের লাশ। হাকিম ডাকাত এখন মিয়ানমার আরাকানের আলেকীন পার্টির নেতা হিসেবেও কাজ করছে।
রোহিঙ্গা এই ডাকাতের কারণে নৈসর্গিক সুন্দর টেকনাফের সবুজ পাহাড়গুলো এখন ভয়ঙ্কর।
পাহাড় নিয়ন্ত্রণে হাকিম ডাকাত হলেও সমতলে রয়েছে আরেক রোহিঙ্গা নসরুল্লাহ। রোহিঙ্গা শিবিরের এই নসরুল্লাহ বাহিনী এখন অপ্রতিরোধ্য। খুন, চাঁদাবাজি, ডাকাতি থেকে শুরু করে সব ধরনের সন্ত্রাসেই এখন নসরুল্লাহ বাহিনী সক্রিয়। তার বাহিনীর সদস্যরাই ছোট ছোট দলের প্রধান হয়ে চষে বেড়াচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরে।
আরসার সঙ্গে রয়েছে নসরুল্লাহর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। গত ৩ এপ্রিল উখিয়া থানা পুলিশ এই দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড নবী হোসেন গ্রেফতার হয়েছে। গোয়েন্দাদের কাছে খবর রয়েছে, নবী হোসেন গ্রেফতার হওয়ায় নসরুল্লাহ বাহিনী যে কোনো সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বা ক্যাম্পগুলোতে হানা দিতে পারে। এ ধরনের প্রস্তুতি তারা নিচ্ছে বলে গোয়েন্দাদের আশঙ্কা।
কক্সবাজারের টেকনাফ উখিয়া সরেজমিনে জানা যায়, দিনে দিনে এই সন্ত্রাসী গ্রুপের শক্তি বাড়ছে। তাদের দলে রোহিঙ্গারা যোগদান করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, এরা নতুন সদস্য সংগ্রহ করছে নানা উপায়ে। ভিডিওবার্তা দিয়েও তাদের দলে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়েছে। ভিডিওবার্তায় এই ডাকাত বলেছে, আমার কাছে এমন সব রোহিঙ্গা আছে, যারা খুন ডাকাতি হামলা লুটসহ যে কোনো ধরনের কাজ করতে পারে। রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে তিনি ভিডিওবার্তায় বলেন, আপনারা আমার দিকে নজরে রাখেন। আমার কথা শুনবেন। আমার আলেকীন পার্টিতে (আরাকান মুসলিম স্বাধীনতা গ্রুপ) যোগ দিন। ’ কেউ কেউ তার এই আহ্বানে দলে যোগদানও করছে।
সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে বর্বরতার শিকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেয় বাংলাদেশ। অসহায়ের নামে কেউ কেউ হয়ে উঠছে হাকিম নসরুল্লাহ আর নবী হোসেনের মতো ভয়ঙ্কর দানবে। যা শুধু এই জনপদের জন্য নয়, নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে গোটা বাংলাদেশের জন্য। এমন মনে করছেন স্থানীয়রাও।
টেকনাফের পুরান পল্লানপাড়া পাহাড়ের কয়েক হাজার একর পাহাড় দখল করে রামরাজত্ব কায়েম করেছে হাকিম ডাকাত। ধরে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়, অস্ত্র প্রশিক্ষণসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যা সে করে না। হাকিম ডাকাতের রয়েছে নিজস্ব অস্ত্রধারী চৌকস ফোর্স। সৃষ্টি করেছে নিজস্ব বাহিনী, ট্যাক্স আদায়কারী ও সমন্বয়ক। পাহাড়ের এই রাজার কাছে অনেকটা ‘অসহায়’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তার কারণে এলাকাছাড়া হয়েছে শত শত পরিবার। ঝরেছে অনেক তাজা প্রাণ। হাকিম ডাকাতের অন্যতম সহযোগী হিসেবে রয়েছে আপন সহোদর নজির আহমদ, কবির আহমদ, বশির আহমদ। এরা সবাই মিয়ানমারের মংডু জেলাধীন দক্ষিণ বড়ছরা এলাকার বাসিন্দা জানে আলম ওরফে আবদুল জলিলের ছেলে। স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। রোহিঙ্গা ডাকাত বাহিনী কিছুদিন ধরে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকলেও দুবছর আগে নতুন করে রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে সঙ্গে আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে।
মাত্র ১১ বছর আগে মিয়ানমার থেকে টেকনাফ উপজেলার শাহপরীরদ্বীপে চলে আসে আবদুল হাকিম ডাকাত। এর কয়েক বছর পর ৫ ভাই বশির আহমদ, কবির আহমদ, নজির আহমদ, হামিদ হোছেনকে নিয়ে আসে এপারে। এরপর আবদুল হাকিমের নেতৃত্বে সাগরও নদীতে ডাকাতি শুরু করে। এ ঘটনা শাহপরীরদ্বীপে জানাজানি হয়ে গেলে ৬ ভাই টেকনাফে এসে বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করে। এর মধ্যে ডাকাত আবদুল হাকিম যোগ দেন ‘আল অ্যাকিন’ নামক রোহিঙ্গা বিদ্রোহী জঙ্গি সংগঠনে। এ সংগঠনের সামরিক প্রধান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে উপজেলা-সংলগ্ন পুরান পল্লানপাড়ার জহির আহমদের মেয়েকে বিয়ে করে টেকনাফ বন রেঞ্জের উপজেলা প্রশাসনিক ভবনের উত্তর-পশ্চিম দিকের আনুমানিক এক কিলোমিটার পর্যন্ত বনভূমি দখল করে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিনিয়ত ডাকাতি, চাঁদা দাবি, চাঁদা না দিলে অপহরণ করে। খুনের পর গুম করার ঘটনাও রয়েছে। আবদুল লতিফের ছেলে নুরুল কবির, সিএনজি ড্রাইভার মো. আলী হত্যা, মুন্ডি সেলিম, নতুন পল্লানপাড়ার সিরাজ মেম্বার হত্যা, আবদুল হাফিজ ও তোফায়েল হত্যাসহ অহরহ ঘটনার জন্ম দেয় আবদুল হাকিম ডাকাত। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা অসংখ্য।
থানা সূত্রে জানা গেছে, হাকিম ডাকাতের বিরুদ্ধে ডজন খানেক মামলা রয়েছে। জানা গেছে, ছোট ছোট ২২টি পাহাড় রয়েছে। অন্তত ৭টি পাহাড় হাকিম ডাকাতের নিয়ন্ত্রণাধীন। এগুলো হলো বাজনতলী পাহাড়, সাংবাদিক শহীদ হোসেনের বাগানের পাহাড়, জালিয়া পাড়া, ল্যাদা ক্যাম্পের পাহাড়, মোচনী ক্যাম্পের পাহাড় ও কেরনতলী পাহাড়। কুতুবদিয়ার স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তৈরি করা তার ও আরও দুই ভাইয়ের বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র, ট্রেড লাইসেন্সও রয়েছে। পুরান পল্লানপাড়ার গহিন অরণ্যে তার আলিশান ৭টি বাড়ি রয়েছে কাঁটাতারের বেড়ায় সীমানা দেওয়া। মিয়ানমার থেকে আসা শ’খানেক পরিবারকে সে নিজের কাছে আশ্রয় দিয়েছে। যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলছে সশস্ত্র ডাকাত হিসেবে। স্থানীয়রাও বলছেন একই কথা।
পুলিশ জানায়, এসব পাহাড় চষে বেড়ায় হাকিম ডাকাত। পাহাড়ের গহিন জঙ্গলে তার অবস্থান হওয়ায় তার খোঁজ পাওয়া কঠিন। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চারপাশ থেকে অভিযান চালালেও কোনো না কোনো পথ ধরে পালিয়ে যেতে পারে। টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার সাহা বলেন, হাকিম ডাকাত ‘মোস্ট ওয়ানটেড’ আসামি। তার ব্যাপারে প্রশাসন খুবই অ্যালার্ট। শুধু হাকিম ডাকাত নয়, তার কোনো সহযোগীর খোঁজ পেলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
টেকনাফ উখিয়ার ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নসরুল্লাহ বাহিনী। রোহিঙ্গা এই সন্ত্রাসী নসরুল্লাহর বাহিনীতে দুই শতাধিক সদস্য রয়েছে। রয়েছে তার অস্ত্রের ভান্ডার। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি (আরসার) রয়েছে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। তাকে সহযোগিতা করছে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একজন সিআইসি। যা একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৮০ ভাগ সন্ত্রাস ঘটে এই নসরুল্লাহ বাহিনীর কারণে। সুত্র: বাংলাদেশ প্রতিনিদিন
পাঠকের মতামত