প্রকাশিত: ১৩/০৮/২০২০ ৭:৪২ এএম

ঈদুল আজহার আগের দিন ৩১ জুলাই টেকনাফের মারিশবুনিয়া গ্রামের টুইন্যা পাহাড়ে কী ঘটেছিল, তা নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে। সেদিন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান ওই পাহাড়ে উঠেছিলেন। পরে একটি মসজিদ থেকে মাইকে ‘ডাকাত ডাকাত’ বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঘোষণার নেপথ্যে ছিলেন স্থানীয় আয়াজ উদ্দিন ও নুরুল আমিন। তারা দু’জনই পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র‌্যাব। সেই রাতেই গুলিতে নিহত হন সিনহা।

স্থানীয় একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্যে সেদিনের ঘটনার দৃশ্যপট উঠে এসেছে। মারিশবুনিয়া গ্রামের মাথাভাঙ্গা জামে মসজিদের ইমাম জহিরুল ইসলাম প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন। সেদিন আসলে কী ঘটেছিল, তা সমকালের কাছে বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি। জহিরুল নিশ্চিত করেন, সেনাবাহিনীর মতো পোশাক পরেই ঘটনার দিন আসরের নামাজের মিনিট বিশেক আগে এক ব্যক্তি [মেজর (অব.) সিনহা] পাহাড়ের দিকে যাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন একজন সঙ্গী। তাদের সালাম দেন জহিরুল।

এরপর তারা পাহাড়ের দিকে চলে যান।

তবে এশার নামাজের সময় এলাকার বাসিন্দা আয়াজ উদ্দিন ও নুরুল আমিনকে পাহাড়ের দিকে যেতে দেখেন জহিরুল। তারা দু’জন জানান, পাহাড়ে ডাকাত উঠেছে। এটা শোনার পরপরই আয়াজ ও নুরুল আমিনকে ইমাম জহিরুল বলেন, পাহাড়ে কোনো ডাকাত উঠেনি। যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে, তারা প্রশাসনের লোক। একজনের গায়ে সেনাবাহিনীর মতো পোশাক দেখেছেন। তিনি নিশ্চিত, তারা ডাকাত নন। এটা জানার পর ইমামকে চ্যালেঞ্জ করে আয়াজ ও নুরুল বলেন, ‘তারা ডাকাত।’ পরে ইমাম জহিরুলের কাছ থেকে টর্চ নিয়ে পাহাড়ের দিকে আলো ফেলে কাউকে খুঁজতে থাকেন আয়াজ।

প্রতীকী ছবি

টুইন্যা পাহাড়ের বুকে বাড়ি স্থানীয় ইউনুসের। তিনি আয়াজ ও নুরুলকে বলেছিলেন, যাদের ডাকাত বলে মনে করা হচ্ছে, তারা আদৌ ডাকাত নন। দিনের আলো থাকতে পাহাড়ের বিভিন্ন লোকেশন থেকে তারা ছবি তুলছিলেন। ইউনুসের কথাও আমলে নেননি আয়াজ ও নুরুল। অন্য একটি মসজিদ থেকে ডাকাত আসার ঘোষণা দেওয়া হয়। স্থানীয়রাও বিস্মিত, কীভাবে দু’জন নিশ্চিত হলেন যে, তারা ডাকাত। এমনকি কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কেন-ই বা মাইকে ঘোষণা দেওয়া হলো পাহাড়ে ডাকাত এসেছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ইমাম জহিরুল ইসলাম সমকালকে জানান, মাথাভাঙ্গা খালের পাশ দিয়ে টুইন্যা পাহাড়ে ওঠেন ওই দুই ব্যক্তি (সিনহা ও তার সঙ্গী)। শহিদুল্লাহ নামের স্থানীয় এক মাদ্রাসাছাত্রকে রাস্তা দেখিয়ে নেওয়ার জন্য তারা অনুরোধ করেন। পাহাড়ের কাছাকাছি যাওয়ার পর শহিদুল্লাহ ফেরত আসেন। পাহাড়ে যাওয়ার সময় কাজেম মজুমদার নামের একজনের বাড়ির পাশে তারা কিছু সময় দাঁড়িয়ে বিশ্রামও নেন। দিনে তাদের একজনের গায়ের পোশাক দেখে মনে করেছি, সেনাবাহিনীর লোক। কোনো কাজে হয়তো পাহাড়ে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে ব্যাগও ছিল। ওই দিন আসরের নামাজের পর এশা পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান করেন জহিরুল।

এশার আজানের পর স্থানীয় মৌলভি হোসেন আহমেদ ইমাম জহিরুলকে বলেন, ‘উত্তর মারিশবুনিয়া উম্মুল কোয়া জামে মসজিদ থেকে মাইকিং করে পাহাড়ে ডাকাত এসেছে বলে গ্রামবাসীকে সতর্ক করা হচ্ছে।’ দ্রুত জহিরুলকেও তার মসজিদ থেকে মাইকিং করতে অনুরোধ করেন হোসেন আহমেদ। তখন জহিরুল তাকে বলেন, পাহাড়ে যারা গেছে, তারা প্রশাসনের লোক। ভুল করে তাদের ডাকাত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এরপর ইমামের কাছ থেকে নিশ্চিত হওয়ার পর তার মুসল্লিরা ডাকাতদের পেছনে না ছুটে বাড়ি চলে যান। তবে আয়াজ ও নুরুল তাদের কথায় অনড় থাকেন।

জহিরুল বলেন, এশার নামাজ জামাতে আদায় করার জন্য যখন মুসল্লিরা মসজিদে আসছিলেন, তখন বলাবলি করেন- মেরিন ড্রাইভের কাছে একটি প্রাইভেটকার রয়েছে। সেখানে মেজর (অব.) সিনহার নাম লেখা আছে।

এক প্রশ্নের জবাবে জহিরুল ইসলাম বলেন, গত ছয় মাসেও তার মসজিদ থেকে ডাকাত ডাকাত বলে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। তবে মাঝেমধ্যে পাহাড়ি এলাকায় চুরির ঘটনা ঘটে।

জহিরুল আরও বলেন, নুরুল ও আয়াজকে জোর দিয়ে বলেছিলাম, পাহাড়ে লাইট মেরে দেখার দরকার নেই, তারা ডাকাত নন। তারা প্রশাসনের লোক। কেননা, বিকেলে পাহাড়ে ওঠার সময় তাদের আমি নিজের চোখে দেখেছি। শুধু এটা নিয়ে হৈচৈ না করার জন্য তাদের বললেও রহস্যজনক কারণে তারা তা আমলে নিচ্ছিল না। নুরুল আমিনকে এলাকার লোক পুলিশের সোর্স হিসেবে জানে। নুরুল ও আয়াজই ফোনে পুলিশকে পাহাড়ে ডাকাত এসেছে বলে খবর দেয়। তাদের তথ্য সঠিক নয়, এটা বলে বাড়ি চলে যান জহিরুল। পরের দিন সেনা হত্যাকাণ্ড শুনে তারা সবাই মর্মাহত হন।

যে মসজিদ থেকে মাইকিং করা হয়েছে, উত্তর মারিশবুনিয়ার ওই মসজিদের ইমাম মুক্তার আহমেদ বলেন, তার স্ত্রী অসুস্থ থাকায় সেদিন এশার ফরজ নামাজ আদায় করে বাসায় ফিরে যান তিনি। তবে মসজিদে আসার আগেই মাইকে ‘ডাকাত ডাকাত’ বলে ঘোষণা শুনতে পান তিনি।

গতকাল দুপুরে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মাথাভাঙ্গার বাসিন্দা বৃদ্ধ সৈয়দ করিম সমকালকে জানান, ৩১ জুলাই বিকেল ৪টার পর টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ থেকে পূর্বে আধা কিলোমিটার হেঁটে মাথাভাঙ্গা বড় ডেইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সামনে পৌঁছান সেনাদের মতো পোশাক পরা এক ব্যক্তি ও তার সহযোগী। এ সময় তাদের সঙ্গে দেখা হয় সৈয়দ করিমের।

তিনি বলেন, ‘চুল লম্বা একটা লোকসহ আর্মির ড্রেসে এক ভদ্রলোক হেঁটে যাওয়ার সময় সালাম দিয়ে আমি কেমন আছি জানতে চেয়েছেন। এ সময় দু’জনের কাঁধে ও হাতে ব্যাগ ছিল। এ সময় আর্মির লোকটা বারবার হাতের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। এরপর মারিশবুনিয়ার দিকে চলে যান।’

৩১ জুলাই রাত ৮টার পর পাহাড়ে ডাকাত রয়েছে দাবি করে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া নতুন মসজিদে মাইকিংয়ের আওয়াজ শুনেছিলেন বলে জানিয়েছেন মসজিদের নিকটস্থলের বাসিন্দা বৃদ্ধ জালাল আহমদ। তিনি দীর্ঘদিন ওই মসজিদের মুসল্লি। তিনি বলেন, ‘রাতে মসজিদের পেছনে পাহাড়ে লাইটের আলোর দেখা মেলে। এরপর লোকজন হৈচৈ শুরু করেন। ভাতিজা নিজাম উদ্দিন বলেন, মসজিদের মাইকে পাহাড়ে লাইট দেখা যাচ্ছে, হয়তো ডাকাত হবে। এলাকার লোকজন সতর্ক হোন আর যদি স্থানীয় লোকজন হোন, নিচে নেমে আসেন বলে সতর্ক বার্তা দেন। এরপর এলাকার কিছু লোক পুলিশকে অবহিত করে বিষয়টি।

মসজিদের কাছাকাছি পাহাড়ের তীরে বসবাসকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, ‘পাহাড়ের তীরে বসতি হিসেবে প্রায় সময় ডাকাতের ভয় লেগে থাকে। তা ছাড়া ঈদ ও কোরবানির সময় হলে আরও বেশি ভয়ে থাকি। কেননা এই এলাকায় মাঝেমধ্যে ডাকাতির ঘটনা ঘটে থাকে।

স্থানীয়রা আতঙ্কে : মারিশবুনিয়া, মাথাভাঙ্গা ও হামজরপাড়া মিলে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড গঠিত। এই তিন গ্রামে এক হাজার ১৮ পরিবারের সাত হাজার মানুষ রয়েছে। বেশিরভাগেরই বসতি পাহাড়ের পাদদেশে। মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান ও তার সঙ্গী সিফাত তথ্যচিত্র বানানোর জন্য যে পাহাড়ে উঠেছিলেন, সেটি মারিশবুনিয়া এলাকায় অবস্থিত। সেখানকার লোকজন এখন ঘরবাড়িতে তালা দিয়ে অন্য জায়গায় আত্মীয়স্বজনের কাছে আশ্রয় নিচ্ছেন।

মো. সেলিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, স্থানীয়রা ভয়ভীতির মধ্যে আছেন। ফলে লোকজন কারও সঙ্গে কোনো কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না। প্রতিদিন রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন এসে নানাজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এলাকার অনেক লোকজন এখন আর ঘরে থাকেন না। এ ছাড়া মসজিদের পাশে নজির আহমদ, মো. তৈয়ুব, প্রবাসী মো. রফিক, মো. সাইফুল, হোছেন আহমদ ও শফি উল্লাহ, সাইফুলসহ অনেকের ঘরে তালা ঝুলতে দেখা গেছে।

টেকনাফ বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ফরিদ উল্লাহ সমকালকে বলেন, যারা পর্যটক তাদের অনেকেই মইন্যা পাহাড়ে যায়। সেখানে সাগর ও প্রকৃতি অত্যন্ত সুন্দর দেখায়। সমুদ্র সেখান থেকে খুব কাছাকাছি দেখা যায়। পাহাড়ে ওঠার পর ডাকাত বলে সন্দেহ ও পরে যা ঘটেছে, তা ছিল চিন্তারও বাইরে। এ ঘটনায় দায়ীদের বিচার চাই।

জিজ্ঞাসাবাদ চলছে তিন সাক্ষীকে : সিনহার ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলার তিন সাক্ষী আয়াছ উদ্দিন, নিজাম উদ্দিন ও নুরুল আমিনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে র‌্যাব। তারা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বলে জানা গেছে। ঘটনার আগে- পরে তাদের সঙ্গে বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর অনেকবার কথা হয়েছে। এ ছাড়া নুরুল আমিনের মা খালেদা বেগম টেকনাফ থানায় অপহরণের ধারায় মামলা করেন। ওই মামলায় পুলিশ গতকাল নুরুলসহ তাদের তিন সাক্ষীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়ার আবেদন করেন। আদালত ওই আবেদন খারিজ করে দেন।

১৬ আগস্ট গণশুনানি : সিনহা নিহতের ঘটনায় ১৬ আগস্ট গণশুনানির আয়োজন করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। টেকনাফের শামলাপুরের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ে এই শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। প্রত্যক্ষদর্শীদের শুনানিতে অংশ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। সুত্র: সমকাল

পাঠকের মতামত