প্রকাশিত: ২৮/১০/২০১৮ ৮:৪০ এএম

ডেস্ক রিপোর্ট :

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি কয়েদি ও হাজতিদের খাবার সরবরাহ, স্বজনদের সাক্ষাৎ, আমদানি ওয়ার্ডে বন্দি বিক্রি, মেডিকেলে অসুস্থের জায়গায় সুস্থদের রাখাসহ বিভিন্ন খাতে বিনিময় হচ্ছে কোটি টাকার ঘুষ। বন্দিদের সংশোধন করতে কারাগার দেওয়া হলেও সেটি এখন হয়ে উঠেছে টাকার খনি। এমন পরিবেশে মাত্র আট মাস চাকরি করে কোটিপতি বনে গেছেন জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস। তাকে ম্যানেজ করেই ঠিকাদাররা বন্দিদের সরবরাহ করতেন পরিমাণে কম ও নিম্নমানের খাবার। বছরের পর বছর ঘুরেফিরে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই কারাগারে এ খাবার সরবরাহের কাজ পাচ্ছে।

গত শুক্রবার ভৈরবে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসের কাছ থেকে কারাগারে খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদারি ওই তিন প্রতিষ্ঠানের এক কোটি ৩০ লাখ টাকার চেক পাওয়া যায়। এফডিআর, চেক, নগদ টাকাসহ তার কাছ থেকে জব্দ করা হয় প্রায় পাঁচ  কোটি টাকার নথিপত্র। রেলওয়ে পুলিশ ধারণা করছে, সোহেল মাদক চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। মাদক চোরাচালান করে প্রচুর অর্থ আয় করেছেন তিনি। কারা সূত্র জানায়, পুলিশের হাতে গ্রেফতারের পর সোহেলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

ভৈরব জিআরপি থানার ওসি আবদুল মজিদ বলেন, ‘৪৪ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসের কাছ থেকে যে তিন ঠিকাদারের প্রায় দেড় কোটি টাকার চেক উদ্ধার করা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে তিনি স্বীকার করেছেন তা ছিল ঘুষের টাকার চেক।’

চট্টগ্রাম কারা বিভাগের ডিআইজি পার্থ কুমার বণিক বলেন, ‘চট্টগ্রাম কারাগারে খাবার নিয়ে খুব বেশি অভিযোগ নেই। জেলারের কাছে ঠিকাদারদের চেক পাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারব না।’

কারাবন্দি হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি রমজান আলী গত মঙ্গলবার আদালতে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘কারাগারে যে মাছ দেওয়া হয়, তার টুকরো পরিমাণে খুবই ছোট। মাংসের পিস দেখলে চোখ কপালে উঠে যায়। ডালের বাটিতে পানি ছাড়া আর কিছু নেই।’

এক কোটি ৩০ লাখ টাকার চেক তিন ঠিকাদারের : কারাগারে খাবার সরবরাহকারী তিনটি প্রতিষ্ঠানের তিনটি চেক জব্দ করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, ঘুষের তিনটি চেকের মধ্যে আছিয়া এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান দিয়েছে ৪০ লাখ টাকার চেক। চেকটি সাউথইস্ট ব্যাংক ময়মনসিংহ শাখার। একইভাবে প্রিমিয়ার ব্যাংক ময়মনসিংহ শাখায় তানিয়া এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান দিয়েছে ২০ লাখ, ব্র্যাক ব্যাংক ময়মনসিংহ শাখায় এসটি এন্টারপ্রাইজ দিয়েছে ৭০ লাখ টাকার চেক। ২৮ অক্টোবর চেকের টাকা উত্তোলনের কথা ছিল।

দীর্ঘদিন ধরে ঘুরেফিরে এক ব্যক্তির তিন প্রতিষ্ঠান : চট্টগ্রাম কারাগারে খাবার সরবরাহে তালিকাভুক্ত ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থাকলেও দুর্নীতিবাজ কারা কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ঘুরেফিরে এক ব্যক্তির তিন প্রতিষ্ঠানই দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। এর মধ্যে আছে অজয় অ্যান্ড ব্রাদার্স, নরেন্দ্রনাথ সাহা ও এসএস এন্টারপ্রাইজ। তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই মালিক অজয় নন্দী।

৬ মাসে স্বেচ্ছায় ১২ কোটি টাকা লস দিয়ে ডাল সরবরাহ : চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দিদের খাবার ডাল সরবরাহে ৬ মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় লস দেন ‘সাড়ে ১২ কোটি’ টাকা! কোটি টাকা লস দেওয়া প্রসঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নরেন্দ্রনাথ সাহার কর্ণধার অজয় নন্দী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন কারাগারে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করে আসছি আমরা। ঠিকাদারি ব্যবসায় কখনও লাভ হয়, আবার ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে কখনও ইচ্ছা করেই লস দিতে হয়।

মাদক মামলায় ৭ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ : মাদক আইনের মামলায় চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। রেলওয়ে পুলিশ ধারণা করছে, তিনি মাদক চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। মাদক চোরাচালান করে প্রচুর অর্থ আয় করেছেন। তাই মাদক উদ্ধারের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানতে রিমান্ডে নিতে চান বলে জানান ভৈরব জিআরপি থানার ওসি মজিদ।

৪৪ লাখ টাকা আসলে কার? : গ্রেফতারের পর সাংবাদিকদের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস জানান, উদ্ধার করা টাকার মধ্যে ৫ লাখ টাকা তার। বাকি ৩৯ লাখ টাকা কারা বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগের ডিআইজি পার্থ কুমার বণিক ও চট্টগ্রাম কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিকের। ১ নভেম্বর ঢাকার কাশিমপুর কারাগারে জেলারদের সম্মেলন হবে। ওই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আগে তিনি পাঁচ দিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলেন। ওই দুই কর্মকর্তা চট্টগ্রামেই থাকেন। সর্বশেষ দুই মাসের মাসোহারা তার কাছ থেকে চট্টগ্রামে না নিয়ে ঢাকায় গিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা।

তবে চট্টগ্রাম বিভাগের ডিআইজি পার্থ কুমার বণিক তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, সোহেল রানা মাদকাসক্ত। তার ব্যাপারে এর আগে কারা মহাপরিদর্শকের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। এ টাকা কার সেটি তিনিই জানেন। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিকও তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন।

প্রসঙ্গত, ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার ‘অবৈধ ঘুষের’ টাকা, ফেনসিডিলসহ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস ভৈরব রেলওয়ে থানা পুলিশের হাতে শুক্রবার গ্রেফতার হন। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহগামী বিজয় এক্সপ্রেসে ময়মনসিংহ যাচ্ছিলেন। ২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর নরসিংদী থেকে চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার হিসেবে যোগ দেন তিনি

পাঠকের মতামত