প্রকাশিত: ০৩/০১/২০২১ ৯:২৭ এএম

বিশ্বনবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের সময়কালীন ৩ মুজিজার জন্য মক্কার জাবালে সাওর বা গারে সাওর বিখ্যাত।
মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকালে প্রথম রাতে প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গী হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ এ গুহায় অবস্থান করেছিলেন। সেখানে ঘটেছিল ৩টি বিশেষ অলৌকিক ঘটনা।

হিজরতের সময় জাবালে সাওরের গুহায় অবস্থানকালে হজরত আবু বকর (রা.) শত্রুর আক্রমণের ভয়ে চিন্তিত হলে আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করে তাকে অভয় দেন। কিন্তু প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন দুঃশ্চিন্তামুক্ত ও পূর্ণ আস্থাশীল। সে সময় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

যদি তোমরা তাকে (রাসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো, আল্লাহ তার সাহায্য করেছিলেন, যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল। তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন বিষন্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় সান্তনা নাজিল করলেন এবং তাঁর সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখনি। বস্তুত আল্লাহ কাফেরদের মাথা নীচু করে দিলেন আর আল্লাহর কথাই সদা সমুন্নত এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা: তাওবাহ, আয়াত: ৪০)

নবুয়তের অষ্টম বছর মক্কার লোকেরা ইসলাম ও মুসলমান তথা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে চরমভাবে বিরোধীতা শুরু করে। পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ ছিল যে, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের অধিকাংশ অনুসারিকে মদিনাসহ অনেক অঞ্চলে হিজরতের নির্দেশ দেন। আর তিনি মহান আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন।

অবশেষ ৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। মক্কা থেকে রাতের বেলা হিজরতের পর প্রথম মনজিল ছিল জাবালে সাওর এর এ গুহা। যেখানে প্রকাশ পেয়েছিল ৩টি অলৌকিক ঘটনা। যে কারণে মক্কার শত্রুবাহিনী এ গুহাকে সন্দেহ পোশণ করেনি।

কুরাইশদের হত্যার পরিকল্পনায় আল্লাহর সাহায্য:

হিজরতের আগে মক্কার ইসলাম বিদ্বেষীরা ‘দারুন নাদওয়া’ বৈঠকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিরতরে হত্যার পরিকল্পনা করে। তিনি যখন রাতে নিজ বিছানায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, আল্লাহ তখন তাকে হিজরতের নির্দেশ দেন।

হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তার বিছানায় রেখে প্রিয় সঙ্গী হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সঙ্গে নিয়ে মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। আল্লাহ তায়ালা সশস্ত্র কুরাইশ বাহিনীর সামনে দিয়ে সঙ্গী আবু বকরকে নিয়ে নিরাপদে মক্কার ৪ মাইল উত্তরে সাওর পাহাড়েরর একটি গুহায় আশ্রয় নেন।

যেখানে সে রাতে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিরতরে হত্যার জন্য তাঁর ঘরের চারদিকে শত্রুবাহির টগবগে যুবকরা অপেক্ষা করছিল। অথচ তাদের চোখের সামনে দিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন, তারা টেরই পায়নি। সুবহানাল্লাহ!

সকাল হয়ে গেলে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে ঢুকে বিছানায় গিয়ে দেখতে পান যে, হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু শুয়ে আছেন। তাঁর হিজরতের বিষয়টি শুনতে পেয়ে কুরাইশ বাহিনীর টগবগে যুবকরা তাদের পিছু নেয়।

কুরাইশ বাহিনী পিছু নেবে এটি বুঝতে পেরেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গী আবু বকরসহ সাওর পর্বতের গুহায় তিনদিন অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। হিজরতের সময় সাওর পর্বতের গুহায় অবস্থান আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এটি ছিল প্রথম সাহায্য ও অলৌকিক ঘটনা।

গুহায় সাপের আক্রমণের মুখোমুখি!

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সঙ্গী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ভোর হওয়ার আগেই সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুহায় প্রবেশের আগে হজরত আবুবকর রাদিয়াল্লাহু আনহু গুহাটি পরিষ্কার করেন।

গুহার মধ্যে তিনি সাপের খোলস ও অস্তিত্ব দেখতে পান। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন ক্লান্ত। তিনি হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু উরুর ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন।

হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু গুহার ভেতরে অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র নিজ গায়ের চাদর বা কাপড় দিয়ে মুখগুলো বন্ধ করে দেন। যেন বিষাক্ত কোনো প্রাণী আক্রমণ করতে না পারে। কিন্তু একটি ছিদ্র ঢাকতে পারেনি। তাই তিনি পা দিয়ে তা ঢেকে রাখেন।

এ দিকে পা দিয়ে ছিদ্র বন্ধ করে দেয়ার ফলে সাপ গর্ত থেকে বের হতে পারছিল না। পরে সাপটি হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু পায়ে কামড় বসিয়ে দেয়। এর বিষক্রিয়ায় হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। আর তা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখমণ্ডলে পড়তেই তিনি ঘুম থেকে জেগে ওঠেন।

সাপে পায়ে কামড় বসিয়ে দিয়েছে জেনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কামড়ের জায়গা তাঁর পবিত্র মুখের লালা লাগিয়ে দেন। আর তাতেই মুহূর্তের মধ্যে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর পায়ের বিষক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর এ গুহায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ৩দিন ৩ রাত অবস্থান করেন। এটি ছিল সাওর পর্বতের গুহায় সংঘটিত দ্বিতীয় অলৌকিক ঘটনা।

মাকড়সা ও কবুতরের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য:

এদিকে মক্কার শত্রুবাহিনী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে খুঁজতে খুঁজতে সাওর পাহাড়ের গুহার সন্নিকটে এসে উপস্থিত। যেখানে হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু গুহায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেন। আর এ গুহায় অবস্থান গ্রহণ করেন। আল্লাহ তায়ালা এ সময় শত্রুবাহিনী থেকে তাদের রক্ষা করেন।

আল্লাহর হুকুমে ওই গুহার মুখে মাকড়সা এমনভাবে বাসা বেঁধে রাখে। আর কবুতর এমনভাবে বাসা বেঁধে তাতে ডিমে তা দিতে থাকে। যাতে কোনো মানুষ প্রবেশের চিহ্ন অবশিষ্ট থাকে না।

কুরাইশ শত্রুরা গুহার কাছে এসে মাকড়সার বাসা এবং কবুতরের ডিমে তা দেয়ার বিষয়টি দেখে তার মনে করেন যে এ গুহায় কোনো মানুষের প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তাই তারা গুহায় প্রবেশ না করে চলে যায়। এটি ছিল সাওর পর্বতের গুহার ৩য় অলৌকিক ঘটনা। যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বন্ধুকে হেফাজত করেছিলেন।

যার ফলে ৩ দিন ও ৩ রাত অবস্থানের পর সাওর পর্বতের গুহা থেকে সফলভাবে নিরাপদে পবিত্র নগরী মদিনায় হিজরত করতে সক্ষম হন। সে সময়ের ঘটনা বর্ণনায় হাদিসে এসেছে-

হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহুআনহু বলেন, হজরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে (সাওর পর্বতের) গুহায় ছিলাম। আমি মুশরিকদের পদচারণা প্রত্যক্ষ করছিলাম। আমি বললাম- ইয়া রাসূলুল্লাহ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের কেউ যদি পা উঠায় তাহলেই আমাদের দেখে ফেলবে। তিনি বললেন, আমাদের দু’জন সম্পকে তোমার কী ধারণা? আমাদের তৃতীয় জন হলেন- আল্লাহ। অর্থাৎ তিনি আমাদের সাহায্যকারী’। (বুখারি ও মুসলিম)

হিজরতের সময় জাবালে সাওর বা গারে সাওরের ওই ঘটনা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট মুজিজা বা অলৌকিক ঘটনা। আল্লাহর অনুগ্রহে যা তাঁদের উভয়কে শক্রুর আক্রমণ থেকে হেফাজত করেন।

এ থেকে বুঝা যায়, মহান আল্লাহ সাহায্য ও সফলতা দানের নমুনা এমনই। আল্লাহ তায়ালা চাইলে কঠিন বিপদেও তার প্রিয় বান্দাদের হেফাজত করতে পারেন।

উল্লেখ্য, পবিত্র নগরী মক্কার মসজিদে হারাম তথা কাবা শরিফ থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তরে কুদাই মহল্লার আল-হিজরা এলাকায় অবস্থিত সাড়ে ৪শ’ মিটার উচ্চতার এ পর্বত। পর্বতের চুড়ায় অবস্থিত গুহাটি ছিল মাত্র ২ বর্গমিটার প্রশস্ত। যেখানে সঙ্গী হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুসহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৩দিন-৩ রাত অবস্থান করেছিলেন।

পাঠকের মতামত