প্রকাশিত: ১২/১২/২০১৯ ৭:৫৯ এএম

রোহিঙ্গাদের গণহত‌্যার বর্ণনার সময় মাথা নিচু করেছিলেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর এবং নোবেলজয়ী অং সান সু চি। আবার এখনো যারা দেশটিতে বিপদগস্ত এ জাতির সুরক্ষায় করণীয় তুলে ধরার সময় মিয়ানমার পক্ষের দলনেতা সু চি মুখ তুলে শুনেছেন আর প্রমাণ হাজির করার সময় প্রাশ্চাত‌্যে শিক্ষাধারী ‘গণতন্ত্রের নেত্রী’র চোখে ছিল বিস্ময় ও অসহায়ত্ব।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিজে) কয়েক ঘণ্টা শুনানির সময় সংস্থাটির সরাসরি সম্প্রচারে অং সান সু চির অভিব‌্যক্তির এমন রঙ পাল্টাতে দেখা গেছে।

নেদারল‌্যান্ডের হেগে অবস্থিত জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা এই বিশ্ব আদালতে স্থানীয় সময় দশটা আর বাংলাদেশ সময় বিকেল তিনটার দিকে মিয়ানমারের ঐহিত‌্যবাহী পোশাক আর খোপায় তাজা ফুল পরে পৌঁছেন সু চি।

শুনানি শুরু হওয়ার পর থেকে গাম্বিয়ার পক্ষে যুক্তি-প্রমাণ হাজিরের সময় বক্তাকে দেখানোর ফাঁকে আদালতে বিচারক প‌্যানেল কিংবা এজলাসে উপস্থিত কয়েকশ মানুষের চেয়ে সু চির দিকেই বারবার এসেছে আইসিজির ক‌্যামেরা।

একেবারে শুরুর দিকে গণহত‌্যার বাদী আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া যে মিয়ানমারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় আশু ব‌্যবস্থার আবেদন করেছে তা তুলে ধরেন আইসিজের রেজিস্ট্রার ফিলিপ গটিয়ে। এরপরই গাম্বিয়ার অ‌্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু।

তামবাদু বিশ্বের নানা সময়ে গণহত‌্যা ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের দায় নিয়ে কথা বলেন। সু চিসহ সবাই তা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।

গাম্বিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের কোনো বিরোধ নেই জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘রুয়ান্ডার গণহত‌্যা থেকে বেঁচে যাওয়া একজন হিসেবে আমি জানি এর স্বরূপ। সভ‌্য সমাজ হিসাবে আমরা এর দায় এড়াতে পারি না।’

তামবাদু বাংলাদেশে সফর এবং জীবন বাঁচিয়ে পালিয়ে আসা অনেক রোহিঙ্গার সঙ্গে আলাপের প্রসঙ্গ তুলে বলেন, আমি দেখেছি মৃত‌্যু থেকে বেঁচে আসা মানুষদের কষ্ট। শুনেছি সেসব মায়েদের দিনরাত চোখের পানি পড়তে যারা এই চোখ দিয়ে নিজের শিশুসন্তানকে আগুনে ছুঁড়তে দেখেছেন। মা-বোনকে দিন-রাত ধর্ষণ দেখতে হয়েছে রোহিঙ্গা পুরুষদের, আবার পুরুষদের সারি করে বসিয়ে গুলি করা হত‌্যার দৃশ‌্য দেখতে হয়েছে রোহিঙ্গাদের মা-বোনদের।

এই কথাগুলো বলার পুরোটা সময় মাথা নিচু করেছিলেন নোবেলজয়ী সু চি, তার দৃষ্টির একটু নাড়াচাড়া হলেও সে দৃশ‌্য চলে এসেছে আইসিজের সরাসরি সম্প্রচারে।

গাম্বিয়ার অ‌্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘রাতারাতি মিয়ানমারে এ গণহত‌্যা হয়নি, দশকের পর দশক বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে। মিয়ানমারে গণহত‌্যার সমস্ত দায়িত্ব অস্বীকার করেছে দেশটির রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকা সব পক্ষ।’

এবার অং সান সু চি একটু মাথা তুলেন, কিন্তু সে সময় নিজের তরুণ বয়সে গণহত‌্যা দেখার দুঃসহ স্মৃতি, নিজ কানে শোনা রোহিঙ্গাদের নির্যাতনে ভয়াবহ বর্ণনা আর জাতিসংঘের ফ‌্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির পাওয়া মর্মান্তিক গণহত‌্যার তথ‌্যপ্রমাণ তুলে ধরতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী।

তিনি আবেগক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘বছরের পর বছর হাজার হাজার মানুষকে হত‌্যা, শিশুদের পুড়িয়ে মারা, নারীদের ধর্ষণের কারণে আজ নিজেদের বসতভিটা থেকে বাংলাদেশে এসেছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।’

যখন কষ্টজড়িত কণ্ঠে গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী বলেন, ‘শরণার্থী কেবল একটা সংখ‌্যা নয়, প্রত‌্যেকটি সংখ‌্যাই একেকজন মানুষ, তখন সুচি আবার মুখ নিচু করে তাকিয়েছিলেন মেঝেতে। আবারও আইনমন্ত্রী এজলাসের সবার উদ্দেশ‌্যে বলেন, আপনার আমার শিশুরা যেভাবে খেলে, সেভাবে খেলার অধিকার আছে রোহিঙ্গাদের ছেলে-মেয়েদেরও, তাদেরও আমাদের বাচ্চাদের মতো স্কুলে যাওয়ার অধিকার আছে।’

‘কালো রোহিঙ্গা নারীদের কাছেও যাবে না সেনারা’

তবে শুনানিতে যখন পাঁচজন বক্তার বক্তব‌্যের শুরু করেন সে সময় অং সান সু চি মাঝে মাঝেই তাকিয়েছেন সামনের দিকে।

যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী তাফাদজ পাসিপান্দো শুনানিতে বলেন, ‘রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণের কথা অস্বীকার করে সু চিই বলেছেন, কালো আর নোংরা বাঙালিদের কাছেও যাবে না রোহিঙ্গা সেনা বা মিয়ানমারের অন‌্য লোকেরা।’

এ সময় সু চি অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবীর দিকে। যেন নোবেলজয়ী বুঝতেই পারেননি তার নিচু মন মানসিকতার কথাটা চলে আসবে বিশ্বমঞ্চে।

মার্কিন আইনজীবী রোহিঙ্গাদের জমি কেড়ে নেয়া, এমনকি পুকুরের মাছ তুলে নিয়ে যাওয়া আর মিয়ানমারে এখনো অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের চলাফেরায় বাধা নিষেধের কথা বলার সময়ও আরেকবার মাথা নিচু করেন সু চি।

তবে অবাক হয়ে তাকান গাম্বিয়ার পক্ষের বক্তারা যখন প্রেজেনটেশনে সু চির দপ্তর থেকে গণহত‌্যাকে আড়াল করতে ফেসবুকে প্রচারণার সচিত্র প্রমাণ তুলে ধরেন। আবার স‌্যাটেলাইট ইমেজ ব‌্যবহার করে জাতিগত নিধনের সচিত্র প্রেজেনটেশন তুলে ধরার সময়ও সু চিসহ তার নেতৃত্বে আসা প্রতিনিধিদলের সদস‌্যরা অপ্রস্তুত অবস্থার মধ‌্যে পড়েন।

পাঁচ বক্তা যখন গণহত‌্যা ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভবিষ‌্যৎ করণীয় নিয়ে কথা বলেছেন, তখন শুধু একটু স্বস্তি দেখা গেছে অং সান সু চির চেহারায়।

আইসিজের অন‌্যান‌্য শুনানিতে বিভিন্ন পক্ষের প্বার্শ আলোচনায় দেখা গেলেও সু চি একবারও তা করেননি। দুবার বিরতির সময় শুধু বোঝা গেছে শুনানিতে কয়েকশ মানুষ, বাকি পুরো সময় সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন গণহত‌্যার আদ‌্যপ্রান্ত। শুনানি শেষ হবার পরও সফরসঙ্গীদের সাথে কথা বলতে দেখা যায়নি। নিশ্চুপ সু চি বের হবার সময় সরাসরি সম্প্রচার শেষ হয়।

পাঠকের মতামত

আশ্রয় নেওয়া বিজিপিদের বিনিময়ে বাংলাদেশি বন্দি মুক্তি দেবে মিয়ানমার

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) সদস্যদের ফেরানোর বদলে দেশটির জান্তা সরকারের কারাগারে থাকা ...

মিয়ানমারের পরবর্তী নির্বাচন দেশব্যাপী নাও হতে পারে: জান্তা প্রধান

মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরলে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারের। তবে সে নির্বাচন ...

এমভি আবদুল্লাহতে বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র বসিয়েছে জলদস্যুরা

সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নিজস্ব ...