প্রকাশিত: ২৪/০৫/২০১৭ ৭:১৮ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৫:৩৮ পিএম

দীপ্তি পাল। টাকার অভাবে বেশিদূর এগোয়নি তাঁর পড়াশোনা। এসএসসির ফরম পূরণের টাকাও জোগাড় করতে পারছিলেন না। অনেক কষ্টে নিজের পরিশ্রমের টাকায় পূরণ করলেন ফরম। পাস করেন এসএসসি। এর পর নিলেন নার্সিং ডিপ্লোমা। স্বপ্ন ছিল মেয়েকে চিকিৎসক বানাবেন।

সেই স্বপ্নও পূরণ হলো। মেয়ে পাস করেন এমবিবিএস। বর্তমানে দীপ্তি কক্সবাজার নার্সিং ইনস্টিটিউটের সুপারভাইজার। আর মেয়ে অ্যানি পাল বাপ্পী কক্সবাজার সদর হাসপাতালে শিশুবিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসক। মা-মেয়ের সাফল্যের গল্প শোনাচ্ছেন : তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার

দীপ্তি পাল টাকার অভাবে পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে পারছিলেন না। সহায়তা চেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর আত্মীয় মনিকা পালের কাছে। মনিকা তখন কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আয়া। তিনি দীপ্তিকে একটি টিউশনি জোগাড় করে দিলেন। দীপ্তি এর পর গেলেন আরেক আত্মীয় কুসুমবালার কাছে। তিনি ছিলেন ধাত্রী। কুসুমবালা নার্সিং শেখান দীপ্তিকে। কিন্তু নার্সিংকে পেশা হিসেবে নিতে হলে লাগবে ডিগ্রি। ওই সময় নার্সিং ডিপ্লোমা করতে কমপক্ষে এসএসসি পাস হতে হবে। দীপ্তির ইচ্ছা, ডিপ্লোমা তাঁকে করতেই হবে। এ জন্য এসএসসিও পাস করা দরকার। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন ফরম পূরণের টাকা।

টিউশনি করে টাকা জোগাড় করলেন। পরিশ্রমের টাকায় এসএসসির ফরম পূরণের সুযোগও হলো এবার। চকরিয়ার ডুলাহাজারা হাই স্কুল থেকে ফরম পূরণ করলেন এসএসসির। এই গল্প ১৯৮১ সালের।

অবশেষে দীপ্তি পাল এসএসসি পাস করলেন। এর পর গেলেন চট্টগ্রাম নার্সিং ইনস্টিটিউটে। ভর্তি হলেন নার্সিং কোর্সে। সাফল্যের সঙ্গে পাস করলেন নার্সিং কোর্স। দীপ্তি এবার যান চকরিয়ার মালুমঘাট খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে। সেখানে নিলেন চাকরি। ঘরে তাঁরা দুই বোন। দুজনেরই সমানে বিয়ের বয়স। সেই সাথে বেকার এক ভাইও। অভাবের সংসার। ঘানি টানা শুরু করলেন দীপ্তি। হাসপাতালের চাকরির টাকায় দুই বোনকে বিয়ে দিলেন। ছোট ভাইকে করে দিলেন একটি ঘরও।

সবার বড় দীপ্তি। কিন্তু তাঁর কথা ভাবে কে? ছোটদের এক প্রকার দাঁড় করিয়ে দিয়ে এবার বসলেন বিয়ের পিঁড়িতে। জীবনসঙ্গীও একজন স্বাস্থ্যকর্মী। নাম তাঁর বাদল কান্তি পাল। ১৯৮৭ সালে দীপ্তি-বাদল দম্পতির কোলে আসে এক কন্যা সন্তান। নাম রাখলেন অ্যানি পাল বাপ্পী। ওই বছরেই দীপ্তি সরকারি হাসপাতালে নার্স হিসেবে যোগদান করেন।

দীপ্তি একজন নার্স। সমাজে নার্স নিয়ে আছে নানা কথা। কিন্তু নার্সিংয়ের মজাই আলাদা জানিয়ে দীপ্তি বলেন, ‘নার্সিং পেশায় আত্মতৃপ্তি আছে। যা অন্য পেশায় নেই। মানবসেবার কাজ এই পেশায় করা যায় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে। তাই মাথায় চিন্তা ছিল কন্যা বাপ্পীকেও মানবসেবার পথ ধরিয়ে দেব। ’

‘ভগবান আমার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। আমার মেয়ে সিলেট নর্থ-ইস্ট মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করেছে এমবিবিএস। ’-যোগ করেন দীপ্তি পাল।

বেসরকারি মেডিক্যালে ভর্তির সময় এককালীন টাকা জোগাড় করা হয়েছিল বেশ কয়েকজন আত্মীয়ের কাছ থেকে। সুখে-দুঃখে খেয়ে না খেয়ে দীপ্তি-বাদল দম্পতি মেয়েকে চিকিৎসক বানিয়েই ছাড়লেন। ডা. অ্যানি পাল বাপ্পী কক্সবাজার সদর হাসপাতালে শিশুবিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসক। নার্স মায়ের সেবার পথ ধরে চিকিৎসক-কন্যা ওই কেন্দ্রের অটিজম শিশুদের সেবা দিচ্ছেন।

গরিব পরিবার থেকে উঠে আসা দীপ্তি পাল এখনো পরিবারের সদস্যদের স্বাবলম্বী করার পেছনে ছুটছেন। গ্রাম থেকে নিজের দেবরকে শহরে এনে পড়ালেখা শিখিয়েছেন। শহরের বাসায় নিয়ে এসেছেন নিজের ভাসুরের এক সন্তানকেও। তাকে দীপ্তি নিজের খরচে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন।

দীপ্তি কক্সবাজার নার্সিং ইনস্টিটিউটের নার্সিং সুপারভাইজার। তাঁর স্বামী বাদল কান্তি পাল কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের সহকারী সেবক। তাঁদের সংসারে আরেকটি মেয়ে রয়েছে। নাম তার তিন্নি পাল জয়া। মেয়েটি মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাকে বিশেষ পদ্ধতিতে লেখাপড়া শেখানো হচ্ছে। দীপ্তির কথা, ‘মানুষের সেবা করার মতো সুখ আর কোথাও নেই। এই সুখ সুখি করে গোটা পরিবার। যার প্রমাণ আমি দীপ্তি পাল। ’

দীপ্তি পালের গ্রামের বাড়ি চকরিয়ার হারবাংয়ে। বর্তমানে তিনি কক্সবাজার শহরের সরকারি হাসপাতাল সড়কের বঙ্গপাহাড় এলাকায় থাকেন।

সুত্র : কালেরকন্ঠ

পাঠকের মতামত