প্রকাশিত: ২৫/১১/২০১৬ ৭:২০ পিএম

img_20161124_100324কনক বড়ুয়া::
এশিয়ার দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের রামু উপজেলার রাজারকুল ইউনিয়নে অবস্থিত এই প্রাচীন বাংলার সুপ্রাচীন ইতিহাস অার ঐতিহ্যের ধারক খৃষ্ট পূর্ব ৫ম হতে খৃস্টীয় ষোড়স শতাব্দীর ইতিহাস অার ঐতিহ্যের ধারক এই বৌদ্ধ তীর্থ ভূমি।

এই তীর্থ টির নাম রাংকুট। রাং অর্থ ভগবান গৌতম বুদ্ধের বক্ষাস্থি, অার কুট অর্থ চূড়া বা পর্বত; অর্থাৎ এটি বুদ্ধের বক্ষাস্থির পর্বত। ইতিহাস ও পাথরে খোদাই করা বিভিন্ন শিলালিপি সূত্রে জানা গেছে, খ্রীষ্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে মহামতি গৌতম বুদ্ধ লক্ষাধিক চারি অসংখ্য কল্প পারমী পূর্ণ করে সিদ্ধার্থ হয়ে জন্ম নিয়ে ২৯ বছর বয়সে ৬ বছর কঠোর সাধনা করে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। বুদ্ধত্ব লাভের পর পর বুদ্ধ শরণাপন্ন প্রথম দ্বিবাচক উপাসক তপসসু ও ভল্লিক (মায়ানমার) এর ফাং(নিমন্ত্রণ) গ্রহণ করেন।

খ্রীষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতেক দীর্ঘ ৬ বছর পর বুদ্ধ তাঁর সেবক অানন্দকে নিয়ে বার্মা যাওয়ার পথে এই পর্বতে উপবেশন  করার সময় অানন্দকে বলেন- “বুদ্ধ ৩৫ বছর বয়সে বুদ্ধ হয়ে ৮০ বছর পরমায়ু লাভ করে পরিনির্বাপিত হবে। তার মধ্যে ৪৫ বছর ধর্ম প্রচার করবে তা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ৮৪ হাজার ধর্ম স্কন্ধে(বানীতে) রুপান্তরিত হবে। যার নাম হবে ত্রিপিটক (সূত্র পিটক ২১ হাজার, বিনয় পিটক ২১ হাজার, অার অভিধর্ম পিটক ৪২ হাজার, মোট ৮৪ হাজার)। ধর্ম প্রচারের পর বুদ্ধ কুশিনারাতেই পরিনির্বাপিত হবেন এবং এসময় সারিপুত্র ও মৌদগলায়ন এই অগ্রশ্রাবকদ্বয় জীবিত থাকবে না। মহাকাশ্যপ স্থবির বুদ্ধের দাহকার্য সম্পাদন করার পর বুদ্ধের শরীরের সমস্ত ধাতু(অস্থি) নিজে একটি গুহার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখবে। খ্রীষ্টপূর্ব ৩০৪ এ পরিনির্বাণের ২৩৯ বছর পরর এই ধরাধামে এমন একজন মহাপুরুষ জন্ম নিবে যিনি অামার প্রচারিত ৮৪ হাজার ধর্মবাণীকে সারা বিশ্বে প্রচারের জন্য ৯৬ কোটি স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করে ৮৪ হাজারটি ধাতু চৈত্য নির্মাণ করে প্রতিটি চৈত্যে অামার শরীরের ক্ষুদ্রানুক্ষুদ্র অংশ প্রতিষ্ঠা করবে। সেই ৮৪ হাজার ধাতুচৈত্যের একটি চৈত্য এই পশ্চিম সমুদ্রের পূর্বতীরে রম্যবতী(রম্মাওয়াদী) নগরের পর্বত শীর্ষে স্থাপিত হবে। সেই চৈত্যে অামার বক্ষাস্থি প্রতিষ্ঠা করা হবে। তখন ইহার নাম হবে ‘রাংকুট’।” এই বলে বুদ্ধ বার্মায় চলে গিয়েছিলেন।

বুদ্ধের পরিনির্বাণের ২৩৯ বছর পর পৃথিবীতে সেই মহাপুরুষ সম্রাট অশোক জন্ম নিলেন। তিনি ছিলেন রাজার পুত্র এবং হাজার হাজার মানুষ হত্যা করতেন। একদিন তিনি মৌদগলিপুত্ততিষ্য স্থবিরের ধর্মের সারবাণী শুনে বুদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেন। সম্রাট অশোক বুদ্ধের বাণীগুলো পুন পর্যালোচনার জন্য তৃতীয় বৌদ্ধ মহাসম্মেলন করেন এবং মৌদগলিপুত্তশিষ্য স্থবিরের মাধ্যমে বুদ্ধের দেহের অস্থিগুলো গুহা থেকে বের করে ৯৬ কোটি স্বর্ণামুদ্রা ব্যায় করে ৮৪ হাজারটি ধাতু চৈত্য প্রতিষ্ঠা করেন। সেই ৮৪ হাজার চৈত্যের এই রাংকুট চৈত্যটিও একটি অংশ, যা খ্রীষ্টপূর্ব ২৬৮ অব্দে প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর অনেক ভিক্ষুগণ এই তীর্থে অবস্থান করেন এবং ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে অারাকান সামন্ত রাজা চন্দ্রজ্যোতি(চেঁন্দি রাজা) বুদ্ধের বক্ষাস্থিটি নিয়ে সাদা পাথরের ৬ফুট উচু মনোরম বুদ্ধবিম্বের মস্তকে সংযোজিত করে বুদ্ধ বিম্বটি প্রতিষ্ঠা করেন। তারপর রাজা চেঁন্দি বুদ্ধ বক্ষাস্থির প্রতি সম্মান ও গৌরব প্রদর্শনার্থে রাংকুট এর পূর্বে “রাং-উ” শব্দটি যোগ করেন। এই “রাং-উ” শব্দটি পরে ভাষান্তর হয়ে ‘রামু’তে রুপান্তরিত হয়। তখন থেকেই এই বৌদ্ধ বিহারের নামকরন হয় রাং-উ রাংকুট। চারদিকে সবুজ গাছ-গাছালি বনের মধ্যে অাশ্রয়ন বলে বনাশ্রম ও বহু তীর্থযাত্রীর পূর্জাহ বলে মহাতীর্থ এবং হাজার বছরের ঐতিহাসিক বিহার বলে মহাবিহার।

বুদ্ধের বক্ষাস্থি সংযোজিত এই বুদ্ধ বিম্বটিকে মানুষ পূজা ও অারাধনার দ্বারা প্রভূত উপকার ও মঙ্গল সাধিত হয়ে অাসছে তাই অনেকের কাছে এই বুদ্ধ বিম্বটি “ঋদ্ধিময় বুদ্ধবিম্ব” হিসাবে পরিচিত। প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধ বিম্বের বয়স্কাল সুদীর্ঘ বছর হওয়ায় অনেকের কাছে “বুড়া গোঁয়াই”(পুরাতন বুদ্ধ) হিসাবে খ্যাত।

কালের পরিক্রমায় হাজার বছরের ঐতিহ্য এই বৌদ্ধ বিহারটি বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে মাটির তলে তলিয়ে গিয়েছিল। ১৯২৯ সালের এক শুভক্ষণে বঙ্গীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু জগতচন্দ্র মহাস্থবির এই পাহাড়ে এসে মাটির ভেতর থেকে ভঙ্গপ্রায় বুদ্ধ বিম্বটি উদ্ধার করেন এবং পুনঃপ্রাণ সঞ্চার হয়েছিল। তখন থেকেই অজস্র মানুষ বুদ্ধ বিম্বটিকে পূজা ও প্রার্থনা করে বহুবিধ উপকৃত হয়ে অাসছে। বিশেষ করে দীন-দুঃখী ও কষ্টপ্রাপ্ত মানুষেরা এবং জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একান্ত শ্রদ্ধা যুক্ত মনে বুদ্ধের কাছে যা প্রার্থনা করেন তা পূরণ হয়ে অাসছে।

এর পর ১৯৬৬ সালে প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথের এসে রাংকুট বিহারটির অভূত- পূর্ব সংস্কার করে, এই বিহারের মৃত প্রাণকে তাজা করে। পরবর্তী প্রজ্ঞাজ্যোতি মহাথেরর শিষ্য শ্রীমৎ চন্দ্রজ্যোতি মহাথের এই বিহারকে দীর্ঘ ২৬ বছর রক্ষন-বেক্ষন করে ২০০৮ সালে মৃত্যুবরন করলে বৌদ্ধ ভিক্ষু ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের এই বিহার রক্ষার হাল ধরেন। এবং ৫ বছর (২০০৮-২০১৩) পরিচালনা করেন।

২০১৩ সালের ৩ জুলাই তে এসে ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের ভান্তে বিহার পরিচালনার দায়িত্ব দেন বর্তমান বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার অান্তর্জাতিক সচিব, অত্র বিহারের বর্তমান পরিচালক ও বর্তমান বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজের খ্যাতনামা বৌদ্ধ ভিক্ষু  ভদন্ত কে.শ্রী জ্যোতিসেন থের। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে বর্তমান অবধি কে.শ্রী জ্যোতিসেন ভান্তে মহোদয় এই বিহারে সম্রাট অশোক বিম্ব, সীবলী বিম্ব, ৮৪ বুদ্ধের অাসন, ২৮ বুদ্ধের অাসন সুসজ্জিত করণসহ বিকল্প সিঁড়ি নির্মাণ পুর্বক প্রচুর উন্নয়নের দ্বারা অব্যাহত রেখেছে।

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...

একটি ফুল—

একটি ফুল, একটি ফুলের জন্যে কতো নিষ্পাপ গাছ প্রাণ হারালো, এই বর্বর শুকোনের দল বারংবার ...