প্রকাশিত: ২৮/১১/২০১৯ ৯:১১ পিএম

অনলাইন ডেস্ক
কোনো প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সঙ্গেই যেন সম্পর্ক জমছে না দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মিয়ানমারের। এরই ধারাবাহিকতায় শেষ পর্যন্ত নিজেদের শ্রেষ্ঠতম মিত্ররাষ্ট্র চীনের সঙ্গেও সম্পর্কে ফাটল ধরতে শুরু করেছে মিয়ানমারের। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্প্রতি মিয়ানমারের একমাত্র মিত্রপক্ষ হিসেবে সরব রয়েছে চীন। এই পরিস্থিতির মাঝে চীন-মিয়ানমার দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনটাই দাবি করেছে মিয়ানমারভিত্তিক বার্তা সংস্থা ইরাবতী নিউজ।

সম্প্রতি দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় একটি সরকার বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে নিয়মিতভাবে সমরাস্ত্র সরবরাহ করছে চীন, এমনই এক বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন দেশটির সেনাবাহিনীর প্রধান মুখপাত্র মায়ো মিন সো। তবে মিয়ানমারের এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে চীন। দেশটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সব সময় মিয়ানমারের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন মনোভাব পোষণ করে চীন। সেক্ষেত্রে এই ধরনের প্রত্যক্ষ অভিযোগ আপত্তিকর।

এদিকে বুধবার (২৭ নভেম্বর) চীনের বিরুদ্ধে এই ইস্যুতে প্রত্যক্ষ অভিযোগের প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের এই সেনা মুখপাত্র জানান, দেশটির তা’আং জনগোষ্ঠী সমর্থিত টিএনএলএ নামক এক চরমপন্থী সংগঠনের সদস্যরা আরপিজি এবং এফএন ৬ এর মত বিমানবিধ্বংসী রকেট লঞ্চারসসহ বিভিন্ন ধরনের চীনা সমরাস্ত্র ব্যবহার করছে। এসব সমরাস্ত্রের অধিকাংশই চীনে তৈরি। মিয়ানমারের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ছাড়াও সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি এলাকায় এই সংগঠনের সক্রিয় তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় বলেও জানান তিনি।

দেশটির সেনাবাহিনীর অনুসন্ধানি তথ্যের বরাতে বার্তা সংস্থাটি জানায়, উত্তরাঞ্চলীয় এই বিদ্রোহীরা হালকা ওজনের স্বল্প পাল্লার শক্তিশালী শান স্টেট এফএন-৬ সার্ফেস টু এয়ার মিসাইল লঞ্চার ব্যবহার করছে , যার প্রতিটির দাম প্রায় ৯০,০০০ মার্কিন ডলার। এসকল মিসাইল লঞ্চারের একমাত্রা প্রস্তুতকারক দেশ চীন।

আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি সমরাস্ত্রের কালোবাজারের তথ্য মতে ধারণা করা হয় যে চীনে তৈরি এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, সুদান এবং পাকিস্তানেও রফতানি করা হয়। এগুলি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধেও ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ চীন এ সকল ক্ষেপনাস্ত্র নিজ তাগিদে কোথাও সরবরাহ না করলে সেগুলো অন্য কোনো পথে এই টিএনএলএ বিদ্রোহীদের হাতে পৌঁছানর কথা নয়।

শুধু তাই নয়, সমরাস্ত্রের পাশাপাশি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অর্থযোগের মাধ্যম হিসেবেও চীনের ভূমিকার কথা দাবি করে মিয়ানমার।

মিয়ানমার প্রশাসনের বরাতে সূত্র জানায়, এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি স্থানীয় কর, মাদক, চাঁদাবাজি এবং তাদের নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি সংস্থা থেকে প্রচুর আয় উপার্জন করছে। দেশটিএ সেনাবাহিনীর ধারনা, চীনের সঙ্গেও এ ধরনের কোনো ইস্যুতেই সম্পৃক্ততা গড়ে উঠেছে বিদ্রোহিদের।

এ প্রসঙ্গে মিয়ানমার সরকারের একজন দায়িত্বাশীল কর্মকর্তা মেজর জেনারেল টুন তুন ন্যিপিটাইউতে জানান, তারা এ সকল সমরাস্ত্র ক্রয়ের অর্থ কোথায় পায়? এর একটাই উত্তর, সম্ভবত তারা মাদক বা প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ থেকে অর্থ পাবে।

বিদ্রোহীদের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্ররের দাবি, এই গ্রুপটি ওয়া ও কাচিন সেনাবাহিনী থেকে অস্ত্র কিনেছে, যাদের অভিযোগ ছিল চীন থেকে তাদের নিজস্ব অস্ত্র উৎদন কারখানা রয়েছে। যেগুলো চীনা প্রযুক্তিবিদদের দ্বারা পরিচালিত।

এদিকে চীনের এশিয়া-বিষয়ক বিশেষ দূত সান গুওচিয়াংয়ের সঙ্গে এক বৈঠকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং অভিযোগ করেছেন যে, উত্তরের বিদ্রোহীরা চীন থেকে অস্ত্র কিনছে।

মাত্র দুই সপ্তাহেরও কম সময় আগে, জাপানের ইয়মিউরি শিম্বুন সংবাদপত্রের সাথে একান্ত সাক্ষাত্কারে মিন অং হ্লাইং বলেছিলেন যে, মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা প্রত্যক্ষভাবে চীন থেকে অস্ত্র পেয়েছিল, তবে তা বিস্তারিতভাবে জানা যায়নি।

তবে মিয়ানমারের জন্য সবচেয়ে ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে দেশটির সবচেয়ে আধুনিক ও শক্তিশালী বিদ্রোহী সেনাবাহিনী ‘ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি (ইউডাব্লুএসএ)’।

মিয়ানমারের দাবি, এটি সেদেশের অন্যতম শক্তিশালী জাতিগত সেনাবাহিনী। ওয়া সেনাবাহিনী এখন অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবস্থায় সজ্জিত, যার জন্য প্রত্যক্ষভাবে চীনকে দায়ি বলে অভিযোগ করেছে মিয়ানমার।

সেনাবাহিনী বর্তমানে রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান এবং ইউক্রেনের পাশাপাশি চীন থেকেও অস্ত্র ক্রয় করছে বলে জানা গেছে। পশ্চিমা দেশগুলি মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তবে অতীতে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড এবং সুইডেন সহ বেশিরভাগই মিয়ানমারে অস্ত্র, ভারী সামরিক সরঞ্জাম ইত্যাদি বিক্রি করতো।

অপরদিকে মিয়ানমার সরকার দাবি করেছে যে, বিভিন্ন সময় দ্বি-পাক্ষীক বিভিন্ন প্রকল্প উন্নয়ন ও মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বি-পাক্ষীক সম্পর্ক জোরদারের ইস্যুতে ক্রমেই তাদের ক্ষেত্রকে সীমাবদ্ধ করে এনেছে চীন। তাছাড়া চীন প্রস্তাবিত নানা প্রকল্পে সম্পৃক্ততা, মিয়ানমারের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে দায়ি বলেও জানায় সু চি সরকার।

সেনাবাহিনীর নেতারা বেইজিংয়ের সাথে মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারের সম্পর্কের উত্থান-পতন পর্যবেক্ষণ করছেন, কারণ মিয়ানমারে বহু বড় বড় চীনা প্রকল্প এরই মধ্যে প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে মিয়ানমার। অনেক ক্ষেত্রে ছেটে ফেলা হয়েছে বিনিয়োগ। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর রাখাইন রাজ্যে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনায় ৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন (১১.৩৩-ট্রিলিয়ন বার্মীজ কেয়াট) ডলালের যে প্রস্তাবনা তা হ্রাস পেয়ে মাত্র ১.৩ বিলিয়ন ডলারে নামানো হয়েছে।

তবে যাই হোক না কেন, বিদ্রোহীদের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ও সমরাস্ত্র সরবরাহ প্রসঙ্গে, মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনীর এমন প্রত্যক্ষ মন্তব্যের ফলে বেইজিংয়ের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক ভাঙতে চলেছে, এমনটাই দাবি স্থানীয় বার্তা সংস্থা সমূহের।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, মিয়ানমারের এমন প্রত্যক্ষ অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় নিরব থাকলেও নিজেদের বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ স্থবির করে মৌন বৈরিতাই জানান দিচ্ছেন চীন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্প্রতি মিয়ানমারের একমাত্র মিত্রপক্ষ হিসেবে সরব রয়েছে চীন। এই পরিস্থিতির মাঝে চীন-মিয়ানমার দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পাঠকের মতামত

মিয়ানমারের পরবর্তী নির্বাচন দেশব্যাপী নাও হতে পারে: জান্তা প্রধান

মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরলে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারের। তবে সে নির্বাচন ...

এমভি আবদুল্লাহতে বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র বসিয়েছে জলদস্যুরা

সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নিজস্ব ...