প্রকাশিত: ২৪/০৬/২০২২ ৭:০২ পিএম

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার থাইংখালী খালের (বালুমহাল) বালু উত্তোলন ও পরিবহন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থক স্থানীয় দুটি পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। মহালের ইজারাদারেরা আওয়ামী লীগের, আর বালু উত্তোলনে বাধাদানকারীরা বিএনপি সমর্থিত বলে জানা গেছে।

মহাল ইজারাদার পক্ষের লোকজনের অভিযোগ, বিএনপি নেতা ও স্থানীয় পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে অস্ত্রধারী একটি দল মহালে গিয়ে বালু উত্তোলনে বাধা দিচ্ছে। বালুর ট্রাক আটকিয়ে চাঁদা আদায় করছে তারা। অন্যদিকে গফুর উদ্দিন চৌধুরীর ভাষ্য, খালের যে অংশ বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা নেওয়া হয়েছে, সেখান থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে সংরক্ষিত বনের ভেতর থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বালু উত্তোলনে বাধা দেওয়া হচ্ছে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, বালু উত্তোলন এবং ট্রাকবোঝাই করে বালু সরবরাহ নিয়ে দুই পক্ষের লোকজনের মধ্যে প্রতিনিয়ত তর্কবিতর্ক হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে থাইংখালী খাল এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, উখিয়ার পাহাড় থেকে সৃষ্ট খালটি আঁকাবাঁকা পথে বালুখালী-থাইংখালী বাজার হয়ে পূর্ব দিকের নাফ নদীতে মিশেছে। খালের কয়েকটি অংশে বালু উত্তোলন করছেন শ্রমিকেরা। সেই বালু ট্রাকে বোঝাই করা হচ্ছে। শ্রমিকেরা বলেন, দৈনিক গড়ে ১০০ ট্রাক বালু উত্তোলন করা হচ্ছে মহাল থেকে। গত ৩ মাসে সরবরাহ হয়েছে অন্তত ৯ হাজার ট্রাক বালু। প্রতি ট্রাক বালুর দাম ৬০০-৯০০ টাকা।

বালুবোঝাই একটি ট্রাকের চালক আবদুর রশিদ (৪০) বলেন, খাল থেকে ট্রাকবোঝাই বালু টেকনাফ নিয়ে যেতে চাইলে চেয়ারম্যানের লোকজনকে ৩০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হচ্ছে। নইলে মারধর করা হয়। আরেক ট্রাকের চালক খায়রুল বশর (৪৫) বলেন, চাঁদা না দিলে বালুবোঝাই ট্রাক পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের সামনে রেখে দেওয়া হয়।

বালুমহালের ইজারাদার কক্সবাজার শহরের নতুন বাহারছড়া এলাকার বাসিন্দা শাহিনুল হক ওরফে মার্শাল। গত ৬ এপ্রিল তিনি থাইংখালী খালের এই বালুমহাল এক বছরের জন্য (১৪২৯ বাংলা সন) জেলা প্রশাসন থেকে ১ কোটি ২ লাখ ১০০ টাকায় ইজারা নেন। মহালের অংশীদার ১০০ জনের বেশি। তাঁদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।

শাহিনুল হক অভিযোগ করেন, মহাল থেকে বালু উত্তোলনের সময় বিএনপি নেতা গফুর উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা দৈনিক পাঁচ হাজার টাকা করে চাঁদা দাবি করছেন। অন্যথায় বালু উত্তোলন করতে দেবেন না বলে হুমকি দিচ্ছেন। ভয়ে ব্যবসায়ীরা বালু উত্তোলন করতে পারছেন না। হুমকির বিষয়টি গত ১৮ মে তিনি জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। এরপরও বালুভর্তি ট্রাক আটকে চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি চাঁদার দাবিতে মহালের অংশীদারদের হামলা ও মারধর করা হচ্ছে।

১৬ জুন কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (উখিয়া) ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরীকে প্রধান আসামি করে সাতজনের বিরুদ্ধে মহাল থেকে বালু উত্তোলনে বাধা এবং বালুবোঝাই ট্রাক আটকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগে মামলা করেন উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের বাসিন্দা সিরাজুল মোস্তফা। অংশীদারদের পক্ষে তিনিই মহালটি পরিচালনা করছেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, ১৪ জুন গফুর উদ্দিনের নেতৃত্বে অভিযুক্তরা ঘটনাস্থলে গিয়ে অস্ত্র দেখিয়ে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে বন্দুকের বাঁট দিয়ে সিরাজুল মোস্তফার (বাদী) মাথায় আঘাত করেন। এরপর পিস্তল ধরে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা লুট করেন। সাত দিনের মধ্যে দাবি করা চাঁদা না দিলে অপহরণের পর লাশ গুম করার হুমকি দেন।

আদালত অভিযোগটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেন। উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, মহালের বালু উত্তোলন ও সরবরাহ নিয়ে দুই পক্ষকে শান্ত থাকতে বলা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত চলছে। শিগগিরই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজল কাদের ভুট্টু প্রথম আলোকে বলেন, সরকারকে কোটি টাকা ইজারা দিয়েও মহাল থেকে বালু তুলতে পারছেন না ইজারাদারের লোকজন। গফুর উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে বিএনপির সমর্থক কিছু লোক চাঁদার দাবিতে অবৈধ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে। গফুর উদ্দিন উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। বালু উত্তোলনে বাধা এবং চাঁদা আদায়ের ঘটনা নিয়ে দুই পক্ষের লোকজনের মধ্যে যেকোনো সময় সংঘর্ষ লেগে যেতে পারে। মহালের অংশীদারদের অনেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।

একই অভিযোগ করেন স্থানীয় ৫ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুস শুক্কুর। তিনি বলেন, চাঁদা না দিলে চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসীরা বালু উত্তোলন করতে দিচ্ছে না। বালুবোঝাই ট্রাক আটকে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়েই দুই পক্ষ মুখোমুখি।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এম এ মনজুরকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে তৃতীয়বারের মতো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন গফুর উদ্দিন চৌধুরী। নির্বাচনে তাঁর বিরোধী অনেক লোকজন এখন বালুমহালের অংশীদার। তাঁদের শায়েস্তা করতেই বালু উত্তোলনে বাধা দিচ্ছেন চেয়ারম্যান।

চাঁদা আদায় এবং চাঁদা দাবির বিষয়টি ভিত্তিহীন মন্তব্য করে গফুর উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে বালু উত্তোলনের জন্য খালের (মহালের) যে চারটি অংশ ইজারা নেওয়া হয়েছে, সেখানে তেমন বালু নেই। এখন ১৩ কিলোমিটার দূরে বনাঞ্চলের ভেতর থেকে দৈনিক ৪০০-৫০০ ট্রাক বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। তাতে পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি হচ্ছে দেখে বালু উত্তোলন বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। মিথ্যা মামলা দিয়েও হয়রানি করছে।

চাঁদার জন্য ট্রাক আটকে রাখা প্রসঙ্গে গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, অবৈধ বালু পরিবহনের সময় পাঁচটি ট্রাক আটক করা হয়েছিল। পরে চালক থেকে মুচলেকা নিয়ে ট্রাকগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সুত্র: প্রথমআলো

পাঠকের মতামত