প্রকাশিত: ১৯/০৪/২০১৭ ৮:১০ এএম , আপডেট: ১৯/০৪/২০১৭ ৮:১২ এএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::


অনেক আশা নিয়ে বাংলাদেশের গাজীপুরের বাসিন্দা রফিক ও আসমা মণ্ডল তাদের পুত্র আসাদকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। পুত্রকে সেরা চিকিৎসা দিয়েও বাঁচাতে পারেন নি। কিন্তু দেশে ফিরে যাবার পথে সীমান্তেই মৃত্যু হয়েছে রফিকেরও। এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে গত সোমবার বিকাল নাগাদ। আসমার কান্নায় বনগাঁ সীমান্তের মুখর পরিবেশও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। তার কান্নার মাতমকে সান্ত্বনা দেয়ার কোনো ভাষা ছিল না কারও কাছে। প্রশাসন থেকে শুরু করে স্থানীয় বিধায়ক সকলেই এগিয়ে এসে সহায়তা করেছেন। কিন্তু আইনের জটিল প্রক্রিয়ায় ৩০টি ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও রফিকের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট বিকাল পর্যন্ত হাতে না আসায় পুত্রের সঙ্গে স্বামীর মরদেহ নিয়ে দেশে ফেরা হয় নি আসমার। অনেক অপেক্ষার পর স্বামীর মরদেহ রেখেই পুত্রের কফিনবন্দি মরদেহ নিয়ে আসমা ফিরে গিয়েছেন ওপারে। সীমান্তের ওপারে অপেক্ষায় ছিলেন তার স্বজনরা। অবশ্য রফিকের মরদেহের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাবার পর নিয়ম মতো কলকাতাস্থ বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস থেকে ছাড়পত্র নিয়েই নিয়ে যাওয়া হবে রফিকের মরদেহ। তবে সেটা বুধবারের আগে হবে না বলে জানা গেছে।
ক্যানসার আক্রান্ত ১৫ বছরের পুত্রকে চিকিৎসা করাতে এসেছিলেন কলকাতায়। প্রায় ১৫ দিন ধরে বেল ভিউ নার্সিং হোমে চিকিৎসা চলছিল। তবে রোববার পুত্র আসাদের মৃত্যু হয়। সোমবার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস থেকে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র যোগাড় করে রফিক ও আসমা পুত্রের কফিনবন্দি মরদেহ নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বনগাঁ পেট্রাপোল সীমান্তের দিকে। ছেলের অকাল মৃত্যুতে দুজনই ছিলেন শোকে মুহ্যমান। কিন্তু যশোর রোড ধরে হাবড়া এলাকায় পৌঁছানোর পর থেকে শোক সামাল দিতে পারছিলেন না বাবা রফিক। বার বার কেঁদে উঠছিলেন। এক পর্যায়ে গাড়ি পৌঁছে যায় দুই দেশের সীমান্তে। সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ছিলেন রফিক। দ্রুত তাকে বনগাঁ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। তবে নিয়ম অনুযায়ী ময়নাতদন্তের পরেই মরদেহ পরিবারের হাতে তুলে দেয়ার কথা। কিন্তু সোমবার রাত হয়ে যাওয়ায় ময়নাতদন্ত হয় নি। সেই কাজ হয়েছে মঙ্গলবার। রফিকের পরিবারের কয়েকজন মঙ্গলবারই বনগাঁয় এসেছেন। তারাই বুধবার প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র সংগ্রহ করে দেশে নিয়ে যাবেন রফিকের মরদেহ। বর্তমানে মরদেহটি হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। কলকাতার বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস সূত্রে বলা হয়েছে, রফিকের মৃত্যুর বিষয়ে আবেদন জমা পড়লে দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র তৈরি করে দেয়া হবে।
বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, বেনাপোল চেকপোস্টে স্বজনদের করুণ আহাজারিতে বেদনার্ত হয়েছেন উৎসুক মানুষেরাও। রফিক ও আসমা দম্পতি গাজীপুরের গোবিন্দবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা। ছেলে আসাদ অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষার্থী ছিল। বেনাপোল চেকপোস্টে মরদেহ নিতে আসা মৃত রফিকের চাচা খন্দকার আলী জানান, রফিক মণ্ডল পেশায় একজন কৃষক। একমাত্র ছেলেকে বাঁচাতে দেশেই আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন বাবা রফিক। সব জমি-জমা বিক্রি করে ডাক্তারের পরামর্শ মত ৪ মাস ধরে ছেলের চিকিৎসার পেছনে অর্থ খরচ করেছেন। ডাক্তারও আশ্বস্ত করে আসছিলেন, ছেলে আসাদ সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু দিন দিন ছেলের শারীরিক অবস্থা উন্নতির বদলে খারাপের দিকে যাওয়ায় বাবার মন ভালো ছিল না। তাই তিনি আত্মীয়ের পরামর্শে কোনোমতে টাকা-পয়সা জোগাড় করে ছেলেকে উন্নত চিকিৎসা করাতে ১২ই এপ্রিল স্ত্রীসহ তারা কলকাতায় যান। কলকাতায় এসে একটি বেসরকারি নার্সিং হোমে আসাদের চিকিৎসাও শুরু হয়। ১৬ই এপ্রিল হাসপাতালে মারা যায় আসাদ। ভর্তির পর পরই ডাক্তাররা বলেছিলেন ‘ছেলের যে হাল করে এনেছেন, তাতে বাঁচানোর কোনো সুযোগ নেই। অযথা টাকা খরচ না করে বাড়িতে ফেরত নিয়ে যান’।
ছেলের অকাল মৃত্যুর পর স্বামীকেও হারিয়ে এখন স্তব্ধ আসমা। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘ছেলের শোকেই ওর বাবা চলে গেল। ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসতো সে।’ মঙ্গলবার সকালে আসাদের মরদেহ বাংলাদেশে তার স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আত্মীয়স্বজনরা ছেলের মরদেহ নিয়ে গাজীপুরের উদ্দেশে রওনা দেয় বেলা সাড়ে ১১টার দিকে। পিতার লাশ আসার পর এক সঙ্গে পিতা-পুত্রের দাফন করা হবে বলে জানান চাচা খন্দকার আলী।
বাবা-ছেলের এমন মৃত্যুর খবর শুনে চেকপোস্টে উৎসুক মানুষ ভিড় জমায়। তাদের সবার চোখেও ছিল বেদনার ছাপ।

পাঠকের মতামত