প্রকাশিত: ০৯/০৫/২০১৮ ৭:১৫ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৩:০৯ এএম

মাহবুবা সুলতানা শিউলি
আর কত নীচে নামবে দু’পায়া মানুষ নামক বিবেকহীন কিছু জানোয়ার…..!

প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার পাতা খুললে দেখা যায়, প্রথম পাতায় বা কোন না কোন পাতায় ধর্ষণ বা শিশুকন্যা ধর্ষণের ঘটনা নিত্যকার কমন একটি সংবাদ শিরোনাম।

গত ১ মে, মঙ্গলবার, বিকেলবেলায় ৬ বছরের ফুটফুটে এক কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে লালমনিরহাট সদর উপজেলার হারাটি ইউনিয়নের হিরামানিক এলাকায়। শিশুটি মারাইরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১ম শ্রেণির ছাত্রী।
ধর্ষক নরপশুটি একই এলাকার বিনয় চন্দ্রের ছেলে ও দুই সন্তানের জন্মদাতা মহানন্দ (৪০)। জন্মদাতা একারণেই বলছি সে নরপশুটি কোনদিনই কারও পিতা হতে পারেনা। কারণ একজন পিতা কখনই এধরণের জঘন্যতায় লিপ্ত হতে পারে না!

যাইহোক, প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, নিজেদের পাঁকা ধানক্ষেতে বিকেল ৩ টার দিকে শিশুটি হাঁস তারাতে যায়। এ সময় নরপশু লম্পট মহানন্দ (৪০) শিশুটিকে ফুসলিয়ে পাশের ভুট্টা ক্ষেতে নিয়ে ধর্ষন করে। শিশুটি চিৎকার করতে চাইলে ধর্ষক মহানন্দ শিশুটির প্যান্ট শিশুটির মুখে গুঁজে দেয়। একপর্যায়ে ধর্ষক ভুট্টাক্ষেত থেকে দৌঁড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন ভুট্টা ক্ষেত থেকে শিশুটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। বর্তমানে শিশুটি হাসপাতালের গাইনী বিভাগে সঙ্গাহীন অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছে।

দুই সন্তানের জন্মদাতা এই নরপশুকে লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ থেকে গত ৩ মে, বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করা হয়।

শিশু ধর্ষণের খবর শোনে আমাদের বিবেকের দায় এড়াতে পারি না কিন্তু আমরাতো তারপরও কিছুই করতে পারছি না। সমাজটার কি হলো? এভাবে কি সমাজটা পচনশীল হয়ে যাবে? ছোট্ট শিশুগুলি কি একটু স্বাধীনভাবে খেলাধূলা করতে পারবে না! শিশুগুলির বাবা-মারা একটু শান্তিমত বিশ্রামও নিতে পারবেনা দু’পায়া মানুষের মত দেখতে জানোয়ারদের আতংকে!

আটককৃত ধর্ষণকারী নরপশুটি শিশুটির বাবার বয়সী। নরপশুটির ঘরেও শিশুটির মত দু’টি সন্তান রয়েছে। কিন্তু শিশুটিকে ধর্ষণ করতে গিয়ে এই নরপশুর মনে একবারের জন্যও ভাবনা আসেনি যে, সে কতো বড় অন্যায়, জঘণ্য ও ঘৃণিত অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।

বর্তমানে আমাদের সমাজে শিশু ধর্ষণ একটি আতঙ্কের নাম। সভ্য সমাজে ধর্ষণকে সব থেকে বড় এবং ঘৃণ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলে প্রতিদিনই লোমহর্ষক ধর্ষণের ঘটনায় আঁতকে উঠতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শিশু, কিশোরী, তরুণী, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী এমনকি কর্মজীবী নারীরাও প্রতিনিয়ত ধর্ষণের শিকার হচ্ছে যা অন্তরালেই রয়ে যায়। নরপশু ধর্ষকরা দুধের বাচ্চা থেকে শুরু করে ৬০- ৬৫ বছরের বৃদ্ধা নারীদেরকেও ধর্ষণ থেকে রেহায় দিচ্ছেনা। বিকৃত মানসিকতা ছাড়াও বিশেষ করে পারিবারিক বিরোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ও স্বার্থের দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছে শিশু থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সী নারীরা। এরকম ঘৃণ্যনীয় অপরাধ করার ব্যাপারে যে মনস্তাত্ত্বিক শক্তি দরকার, অপরাধীদের এই শক্তির জোগানদাতা কে? এই প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বিকৃত যৌনাকাঙ্খা, যৌনাচার ও বিকৃত মানসিকতা ছাড়াও অধিকাংশ গণধর্ষণ কেসে বা একক ধর্ষণের পেছনে অপরাধীদেরকে শক্তি জোগায় তার রাজনৈতিক পরিচিতি অথবা আর্থিক শক্তির জোর। ধর্ষণ অপরাধের প্রণোদক আর্থিক শক্তিরও পেছনে সাহস জোগায় কালো টাকা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা।

আমরা ছোট্ট ৬ বছরের এ শিশুটির ধর্ষণকারীর সর্বোচ্চ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। কিন্তু এখানে আমাদের সংশয় আছে। কারণ অধিকাংশ সময় দেখা যায়, ধর্ষকরা রাজনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এসব অপকর্ম করে নির্ভয়ে। আবার অধিকাংশ ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের ঘটনার সাথে রাজনীতি জড়িয়ে যায়। যার দরুন অনেক সময় এসব অপরাধের শাস্তি দেবার ক্ষমতা স্থানীয় প্রশাসনের থাকেনা।
আরো দেখা যায়, ধর্ষক বা ধর্ষকগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাবান রাজনৈতিক শক্তির অংশীদার। ধর্ষক ভাবে, তার অপরাধ যাহাই হোক না কেন ক্ষমতা আর টাকার জোরে সে প্রচলিত আইন ও আদালতকে তার নিজের পক্ষে ব্যবহার করতে পারবে। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় ধর্ষক বা ধর্ষকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, আর্থিক ক্ষমতার কাছে মাথা নত করে থানা, পুলিশ, তদন্ত কর্মকর্তা, প্রশাসন, আদালত, সাক্ষী, ধর্ষণ আলামত পরীক্ষাকারী চিকিৎসক ও হাসপাতাল। ফলে অপরাধীরা এক ধরণের দায়মুক্তি পেয়ে যায়।
আমাদের প্রত্যাশা, শিশুটির মৃত্যু হয়নি বলে এ ধর্ষণের বিচারটিতে যেনো হেলাফেলা করা না হয়। বিচারকার্যে কোন অবহেলার শিকার না হয় শিশুটির ক্ষেত্রে।

নারীরা আজ কোথাও নিরাপদ নয়। পরিবারের সদস্য, শ্বশুরালয়, কর্মস্থলের সহকর্মী ও গৃহকর্তা-কর্ত্রী কারো কাছেই যেন নিরাপদ নয় নারী-শিশু। সামাজিক অস্থিরতার কারণে প্রতিনিয়ত কন্যা শিশুরা নিগ্রহ, নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছে। সমাজের কন্যা শিশুরা বিকৃতমস্তিষ্কের বিকারগ্রস্ত, বিকৃতকামী মানুষের সহজ শিকার। সরলতার সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় অবুঝ শিশুদের। শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না নর পিশাচের থাবা। আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। ধর্ষণের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান থাকলেও সে বিধান কার্যত বাস্তবায়ন হচ্ছেনা ধর্ষকের ক্ষেত্রে। একজন খুব সহজেই মুক্ত হওয়ার পর আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে ধর্ষকগোষ্ঠী। এভাবে সহসা বিনা বিচারে ধর্ষণকারীরা পার পেয়ে যাওয়ার ফলে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা।
শিশুর প্রতি এ ধরনের পাশবিকতা আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার সংকট কতোটা প্রকট তার ইঙ্গিত দেয় সাম্প্রতিক ভারতে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক, অবর্ণনীয় স্বরণকালের ধর্ষণ অপরাধের মাইলফলক, সর্বোচ্চ বিকৃত মানসিকতার ইতিহাসের আঁতকে ওঠা লোমহর্ষক ধর্ষণের শিকার ৮ বছরের শিশু আসিফার ওপর ঘটে যাওয়া পাশবিকতা..!

কিছুদিন আগে ভারতের এক ধর্মগুরুর দ্বারাও এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষকের বয়স ৮০-৯০ বছরের মত। যা আমি টিভিতে দেখেছি। তাই ধর্ষক যে কেউ হতে পারে।

ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়ায় এখন কন্যাশিশু ধর্ষণ আরো প্রকট বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সমাজপতিরা ধর্ষকের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেন। আবার অনেক সময় রক্ষকই ভক্ষকের ভুমিকা নেয়। তাই ঘটনার শিকার দরিদ্র পরিবারগুলো সামাজিক বাধ্যবাধকতা মানতে গিয়ে এমন নির্মমতার বিচার চাওয়ারও সাহস দেখান না। উল্লেখ্য ঘটনার শিশুটির পরিবারও গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবার। সহজে অনুমেয় শিশুটির পরিবারও বিড়ম্বনার শিকার হবেন।

নারী ও শিশু নির্যাতনের কঠোর আইন বাংলাদেশে বিদ্যমান আছে। কিন্তু সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, আইনের শাসনের অকার্যকারিতা, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ প্রভৃতি কারণে নারী ও শিশু ধর্ষণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই জন্যই দিনে দিনে শিশু ও নারী ধর্ষণ বেড়েই চলেছে।
অন্যদিকে ভারতে ঘটে যাওয়া ৮ বছরের শিশু আসিফার প্রতি এতটা নৃশংসতা আমাদের মানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এধরণের জঘন্যতার শিকার আসিফাসহ অজস্র কন্যাশিশুরা, তোমরা আমাদের ক্ষমা করো…! তোমাদের জন্য আমরা কিছুই করতে পারছি না। আমরা কি পারি না শিশুধর্ষণের অপরাধীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি শেষে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার জন্য আন্দোলন করতে! তবেই হয়তো আমাদের প্রতিদিন পত্রিকায় পাতায় দেশ ও বিদেশের কোথাও না কোথাও ঘটে যাওয়া এ ঘৃণ্য অপরাধের সংবার আর পড়ার সুযোগ হবে না বা আস্তে আস্তে কমে যাবে! আর ধর্ষিতার নয়, ধর্ষকের ছবি প্রকাশ করে ভাইরাল করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদেরকে আরো আরও বেশি মানবিক হতে হবে। যা আমাদের শিখাবে নিজ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। আর সেটা যদি শিখতে পারি তাহলে আসিফা বা অজস্র শিশুকন্যার মতো অন্যকোন শিশুকন্যাকে এরকম নির্মম নৃশংসতার শিকার হতে হবেনা।
_________________________
কলাম লেখক: মাহবুবা সুলতানা শিউলি
মেম্বার, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ
কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
ইমেইল: [email protected]

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...

একটি ফুল—

একটি ফুল, একটি ফুলের জন্যে কতো নিষ্পাপ গাছ প্রাণ হারালো, এই বর্বর শুকোনের দল বারংবার ...