প্রকাশিত: ২৫/০১/২০২০ ২:৪৮ পিএম

ডেস্ক রিপোর্ট ::
প্রায় এক বছর আগে কক্সবাজার জেলা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করা সেই মাদক ব্যবসায়ীদের অবৈধ সম্পদ এখনও অজানাই রয়ে গেছে। আত্মসমর্পণ করার পর দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক, অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাবর অবৈধ সম্পদ খতিয়ে দেখতে চিঠি পাঠায় জেলা পুলিশ। কিন্তু এখনও সেই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে কোনও মামলা হয়নি। এরই মধ্যে আবারও কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি চলছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, ইয়াবা ব্যবসা করে বিপুল অর্থ-সম্পদ করা ব্যক্তিরা আত্মসমর্পণের মাধ্যমে কি পার পেয়ে যাচ্ছে?

তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথম দফায় ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেছিল। এতজনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে একসঙ্গে অনুসন্ধানের জন্য পর্যাপ্ত লোকবল নেই। এ কারণে পর্যায়ক্রমে ভাগ ভাগ করে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। এসব অবৈধ সম্পদ অর্জনকারী ব্যক্তিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে।

এদিকে আত্মসমর্পণ করা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন কারাগারে মারা যাওয়ায় বাকি ১০১ জনের বিরুদ্ধে গত ২০ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে কক্সবাজার জেলা পুলিশ। আত্মসমর্পণ করা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার বিষয়ে ছাড় দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। সেই অনুযায়ী গত বছরের ৫ মার্চ কক্সবাজারের জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের অনুমতি চেয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর দুটি পৃথক আবেদনও করা হয়েছিল। কিন্তু আইনি জটিলতা থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত মামলা দুটি প্রত্যাহার না করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

গত বছর ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সাড়ে তিন লাখ ইয়াবা ও ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছিল ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী। যার মধ্যে কক্সবাজারের আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির চার ভাইসহ ১৬ জন আত্মীয় ছিলেন। তারা সবাই এখন কক্সবাজার জেলা কারাগারে বন্দি রয়েছেন।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, ‘আত্মসমপর্ণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে যে মামলা হয়েছিল, সেটার চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। তাদের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ করছে।’ এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বড় গ্রুপটি আত্মসমর্পণ করেছে। বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এই এলাকায় দেড় শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। ইয়াবা আসার চালান এখন কমে এসেছে। এখন রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ইয়াবা আনছে। এছাড়া আরও কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী রয়েছে। তাদের ধরতে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন। অনেকেই ইয়াবা ব্যবসার ‘গডফাদার’ হিসেবে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। ২০১৮ সালের মে মাস থেকে মাদকবিরোধী সর্বাত্মক অভিযানে সারাদেশে চার শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। অভিযান শুরুর পর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় অনেকেই। তারপরও মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান আসা বন্ধ হয়নি। হাকিম ডাকাতের দলসহ বেশ কয়েকটি বড় গ্রুপ এখনও সক্রিয় রয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের অনেকেই ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। তারা ইয়াবা এনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দুর্গম এলাকাগুলোতে মজুত করে রাখে।

কর্মকর্তারা আরও বলছেন, শুধু শক্তি প্রয়োগ না করে মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানো হয়। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ‘নমনীয়তা’ দেখানো হবে বলেও জানানো হয়। দীর্ঘদিন মাদক ব্যবসা করে বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে আত্মসমর্পণ করে পার পেয়ে যেতে পারে এমন সমালোচনা শুরু হলে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করা হবে বলে সে সময় জানানো হয়। কিন্তু এক বছরে একজনের বিরুদ্ধেও মামলা হয়নি। ইয়াবার চালান আসা কিছুটা কমলেও একেবারে শূন্যের কোঠায় আনা যায়নি। মাদক ব্যবসায়ীরা রুট পরিবর্তন করে দেশের অন্যান্য সীমান্ত এলাকা দিয়ে ইয়াবা নিয়ে আসছে।

আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে ৪০ জনকে বাছাই করে তাদের সম্পদের অনুসন্ধান করছি। তবে এখনও অনুসন্ধান শেষ হয়নি। অনুসন্ধান শেষ হলে কারও বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একসঙ্গে এত লোকের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে খোঁজ-খবর করার জনবল আমাদের নেই। এ কারণে আত্মসমর্পণ করা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিষয়ে প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের পরে তালিকা ধরে কাজ করা হচ্ছে।’

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্যও একই কথা বলেছেন। তারাও আত্মসমর্পণ করা ১০২ মাদক ব্যবসায়ীর মধ্যে কয়েকজনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন। তবে কারও বিরুদ্ধে এখনও মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করা হয়নি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অপরাধ কর্মকাণ্ড বা অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের জন্য অপরাধীদের সম্পত্তি জব্দ করার নজির রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের অবৈধ অর্থ-সম্পদের একটি বড় অংশ জব্দ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্যই অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কারণ আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ী বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অর্থসম্পদ সাধারণত তাদের উত্তরসূরিরা ভোগ করে থাকেন। তাই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে একটি বার্তা যাবে যে, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ নিজে কিংবা পরিবারের কেউই তা ভোগ করতে পারবে না।সুত্র: বাংলা ট্রিভিউন

পাঠকের মতামত