প্রকাশিত: ২৩/০১/২০২০ ১০:২৯ এএম
গাম্বিয়ার বিচার মন্ত্রী আবুবাকার তাম্বাদু

বিবিসি বাংলা::

গাম্বিয়ার বিচার মন্ত্রী আবুবাকার তাম্বাদু

গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবাকার তাম্বাদুর পদক্ষেপের ফলে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে হেগের আদালতে দাঁড়িয়ে তার দেশের বিরুদ্ধে আনা গণহত্যার অভিযোগ প্রশ্নে বক্তব্য দিতে বাধ্য হয়েছেন। জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত বৃহস্পতিবার যখন ওই মামলায় আদেশ দিতে যাচ্ছে, তখন মিয়ানমারের নেত্রীকে আদালতে আনা ব্যক্তিটির বিষয়ে জানার চেষ্টা করেছেন বিবিসির অ্যানা হুলিগান।

কক্সবাজারে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শিবিরে আবুবাকার তাম্বাদুর সফরটি ছিল অপ্রত্যাশিত।

যখন তিনি বেঁচে ফিরে আসা মানুষজনের কাহিনী শুনছিলেন, তখন মিয়ানমারের সীমান্তের অন্য পাশ থেকেও যেন তিনি গণহত্যার দুর্গন্ধ টের পাচ্ছিলেন।

তিনি বিবিসিকে বলছেন, ”আমি উপলব্ধি করছিলাম, টেলিভিশনের পর্দায় আমরা যা দেখি, পরিস্থিতি আসলে তার চেয়েও কতটা গুরুতর।”

”’রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী এবং বেসামরিক বাসিন্দারা সংগঠিত হামলা চালাচ্ছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, মায়ের কোল থেকে শিশুদের ছিনিয়ে নিয়ে জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে মারছে, পুরুষদের ধরে ধরে মেরে ফেলছে, মেয়েদের ধর্ষণ করছে এবং সবরকমের যৌন নির্যাতন করছে।”

ঠিক যেন রোয়ান্ডার মত’

কাঁপুনি তুলে দেয়ার মতো এই দৃশ্যগুলি মিস্টার তাম্বাদুকে ১৯৯৪ সালে রোয়ান্ডা গণহত্যার ঘটনাগুলোকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল, যেখানে আট লাখের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়।

”রোয়ান্ডায় টুটসিদের ওপর যেরকম অপরাধ করা হয়েছিল, এটা সেরকমই মনে হচ্ছিল। এখানে সেই একই রকম কার্যক্রম হয়েছে, অমানবিক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে গণহত্যার সব বৈশিষ্ট্যই রয়েছে।”

”আমি বুঝতে পারলাম, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য এটা মিয়ানমারের সরকারের একটা চেষ্টা।”

জবাবে মিয়ানমার কী বলছে, সেটা জানা কি প্রয়োজন?
কিছুই না করা কোন কাজ হতে পারে না।

”সব মিলিয়ে এটা মানবিকতার একটা ব্যাপার,” কথা বলার সময় তার কণ্ঠস্বর উঁচুতে উঠে যাচ্ছিল।

”যা আমি শুনেছি আর দেখেছি, ব্যক্তিগতভাবে তাতে আমি ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। পেশাগতভাবে আমি চিন্তা করলাম, এসব কাজের জন্য মিয়ানমারকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। আর সেটা করার মাধ্যম হলো আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে একটি মামলা করা।”

জাতিসংঘের রোয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের সাবেক কৌঁসুলি কক্সবাজারের বাস্তুচ্যুত মানুষদের ক্যাম্পে বসে যা চিন্তা করছিলেন, তা হয়তো শুধুমাত্র কাকতালীয় কোন ঘটনা নয়, যেন সেটা ‘ঐশ্বরিক নিয়তি’ ছিল।

গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। যে ১৪৯টি দেশ ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, তাদের যেকোনো দেশ মামলা করতে পারে। কিন্তু সরাসরি মি. তাম্বাদুর নির্দেশনায় গাম্বিয়া সেই পদক্ষেপ নিয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে গাম্বিয়া আবেদন করেন, যাতে আদালত একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারি করে, যাতে আর কোন সহিংসতা বা ধ্বংসযজ্ঞ না ঘটে এবং রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক কাজের যে কোনও প্রমাণ সংরক্ষণ করা হয়।

মানবাধিকার সংগঠন গ্লোবাল সেন্টার ফর দি রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্টের প্রধান, সাইমন অ্যাডামস বলছেন, কথিত নৃশংসতার দায়ে মিয়ানমারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করার জন্য শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিই সাহস, দক্ষতা এবং মানবতা দেখিয়েছেন।

”অনেকে চীনাদের প্রতিশোধের ভয়ে ভীত। অন্যরা বলেছেন, এই কাজ করার জন্য এটা উপযুক্ত সময় নয়, রাজনৈতিকভাবে এটা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমি তার সাহস দেখে মুগ্ধ। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এর জন্য কতটা চাপ আসতে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা সামলাতে তিনি একটা কৌশল বেছে নিয়েছেন।”

আবুবাকার তাম্বাদু: খেলোয়াড় থেকে আইনজীবী

১৯৭২ সালে জন্ম নেয়া মিস্টার তাম্বাদু গাম্বিয়ার রাজধানী বানজুলে বড় হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন আঠারো ভাইবোনের মধ্যে একজন।

তাঁর পিতার তিনজন স্ত্রী ছিল।

তরুণ বয়সে তিনি খেলাধুলায় খুব ভালো করেন, ফুটবলে তার দেশের জন্য শিরোপা এনে দিয়েছিলেন।

”আমি খারাপ খেলোয়াড় ছিলাম না,” তিনি বিনীতভাবে স্বীকার করেন।

৪৭ বছর বয়সী এই ব্যক্তি তাঁর শৈশব জীবনে ‘ভাগ্যবান’ বলে বর্ণনা করেন। তাঁর মধ্যবিত্ত পরিবার দেশে একটি প্রাইভেট স্কুল এবং ব্রিটেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পড়াশোনার খরচ বহন করতে সমর্থ হয়েছিল।

পিতাকে অসন্তুষ্ট করার ভয়ে তিনি খেলাধুলার স্বপ্ন বাদ দিয়ে দেন এবং একাডেমিক পথে হাঁটতে শুরু করেন।

”আমি কখনোই আইন নিয়ে পড়তে চাইনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে (ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়) প্রথম যে বিষয়টি পড়ার জন্য আমাকে বলা হয়, সেটা ছিল আইনবিদ্যা।”

পড়াশোনা শেষ করে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং একজন সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে কাজ শুরু করেন।

ক্রমে রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠছিলেন তিনি। বুঝে নিচ্ছিলেন গাম্বিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এক পর্যায়ে তিনি ও তাঁর বন্ধুরা মানবাধিকার লঙ্গনের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন।

২০০০ সালে এপ্রিল মাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাম্মেহ’র কুখ্যাত নিরাপত্তা বাহিনী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করে, এতে ১৪জন শিক্ষার্থী, একজন সাংবাদিক এবং একজন রেডক্রস স্বেচ্ছাসেবী নিহত হন।

মি. তাম্বাদু দেখতে পান যে, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে এবং নির্যাতন করা হচ্ছে।

কিন্তু তাঁর পরিবার জাম্মেহর বিরোধিতা করার পরিণতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে এবং তাকে দেশের বাইরে কাজ করতে রাজি করায়।

তখন তিনি আন্তর্জাতিক বিচারের ক্ষেত্রে কাজ করতে শুরু করেন।

এই স্বেচ্ছা নির্বাসন তাকে জাতিসংঘের সেই আদালতে কাজ করার সুযোগ এনে দেয় যেটি রোয়ান্ডা গণহত্যার কুশিলবদের বিচার করার জন্য স্থাপিত হয়েছিল। রোয়ান্ডা সেনাবাহিনীর সাবেক চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল অগাস্টাস বিজিমুনগুর বিচারে তাঁর ভূমিকা ছিল।

তিনি বিশ্বাস করেন, তিনি যা করছিলেন, সেটা শুধুমাত্র রোয়ান্ডার গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্যই নয়।

”এটা ছিল আফ্রিকান সব নেতাদের প্রতি একটা বার্তা….আমি এটাকে দেখি আফ্রিকায় বিচার এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার একটি সংগ্রাম হিসাবে। এটা শুধুমাত্র রোয়ান্ডার ব্যাপার নয়।”

কেন নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন তারা?
২০১৭ সালের শুরুতে জাম্মেহর পতনের পর তাম্বাদু গাম্বিয়ায় ফিরে আসেন এবং প্রেসিডেন্ট আদামা ব্যারোর মন্ত্রিসভায় কাজ করতে শুরু করেন।

বিচারমন্ত্রী হিসাবে যখন তিনি গাম্বিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে নিউইয়র্কে সফর করতে যান, তখন তিনি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বাংলাদেশ সফরে যেতে না পারায় বরং মিস্টার তাম্বাদুকে যাওয়ার অনুরোধ করেন।

তিনি তাঁর ডায়রি ঘেঁটে বলেছিলেন, ”কেন নয়?”

”আপনি এটাকে কাকতালীয় ঘটনা বলে বলতে পারেন,” তিনি হেসে বলেন।

অবশ্য মিস্টার তাম্বাদুর পরবর্তী এসাইনমেন্টটি হয়তো তাঁর বাড়ির কাছেই থাকবে।

গাম্বিয়ার রাজধানী বানজুলে গত সপ্তাহেই একটি বিক্ষোভ শুরু করেছে সাবেক প্রেসিডেন্ট জাম্মেহর সমর্থকেরা। তারা দাবি করছে ইকুয়াটোরিয়াল গিনিতে নির্বাসিত মিস্টার জাম্মেহকে যেন দেশে ফিরতে দেয়া হয়।

একটি ফাঁস হওয়া কথোপকথনের রেকর্ডে গাম্বিয়ার সাবেক এই নেতাকে বলতে শোনা গেছে, তিনি বিক্ষোভকে সমর্থন করছেন।

বিচারমন্ত্রী তাম্বাদু অবশ্য মনে করেন না যে জাম্মেহ ফিরে আসবেন। কিন্তু যদি এসেই পড়েন, মিস্টার তাম্বাদু বলছেন, তাকে গ্রেফতার করা হবে।

”সাধারণ গাম্বিয়ানদের ওপর প্রেসিডেন্ট জাম্মেহ যেসব অপরাধ করেছেন, সেগুলো জন্য তাকে বিচারের মুখোমুখি করতে পারলে এর চেয়ে খুশির আর কিছু হবে না।”

”ভাগ্যক্রমে তাঁর সঙ্গে আমার কখনো কিছু হয়নি। যেদিন থেকে তিনি ক্ষমতা নিয়েছেন, সেদিন থেকে তাঁর নিষ্ঠুর এবং বর্বর পদ্ধতির বিরোধিতা করেছি আমি”।

গাম্বিয়ার কর্তৃপক্ষ এখন ভাবছে, কোথায় আনা হবে জাম্মেহর বিরুদ্ধে অভি।যোগ।

সবগুলো বিকল্পই সামনে আছে – দেশীয় বিচার, আঞ্চলিক ট্রাইব্যুনাল অথবা আন্তর্জাতিক আদালত।

মিস্টার তাম্বাদু মনে করেন, গাম্বিয়ার জন্য বিশ্ব দরবারে অবস্থান গড়ে নেয়ার এখনি সময়।

মানবাধিকারের দিক থেকে তারা নেতৃত্ব দিয়ে উদাহরণ তৈরি করতে চান।

”আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা করার মাধ্যমে গাম্বিয়া দেখিয়ে দিয়েছে যে, নিপীড়নের নিন্দা করার জন্য সামরিক শক্তি বা অর্থনৈতিক শক্তির দরকার নেই। বড় বা ছোট সমস্ত রাষ্ট্রের জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা এবং নৈতিক দায়িত্ব সমান।

আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মামলা করার প্রাথমিক লক্ষ্য হলো রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে, সে ব্যাপারে বিশ্বব্যাপীকে কিছু করার জন্য তাগিদ দেয়া।

”ফলাফল যাই হোক না কেন, আদালত অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিন বা না দিন, আমরা চেয়েছিলাম মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর কি ঘটছে, সে ব্যাপারে বিশ্ববাসী সজাগ হোক- আমি মনে করি মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ এখন জানে যে, বিশ্ববাসীর চোখ এখন তাদের ওপরে।”

”ফলাফল যাই হোক না কেন, এই মামলায় রোহিঙ্গাদের কিছুটা জয় হয়েছে।”

পাঠকের মতামত

ইরানের ভয়ে তটস্থ ইসরায়েল!

ইসরায়েলে বড় ধরনের ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন হামলা আসন্ন বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ...